টেলিগ্রাফের তার ও ফিঙের লেজ

আমার ছোটবেলায় আমরা যখন বাসে করে মামাবাড়ি যেতাম তখন শহর ছাড়ামাত্রই দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত শুরু হয়ে যেত। ধানক্ষেতের সীমানা বরাবর দেখা যেত ধুসর গাছের সারি। মনে হত যেন ওটাই পৃথিবীর শেষ। আমাদের কল্পনায় চলন্ত বাসের থেকে আমরা কত কিছুই না জানি ভেবে নিতাম। কখনও সবুজ কখনও ধূসর ধানক্ষেতের সাথে সাথে চলত অধূনালুপ্ত টেলিগ্রাফের তার। ভারি মজার ছিল। দুটো তার পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে থাকত। রাস্তায় বাস চলত আর তার পাশেপাশে তারদুটি সঙ্গীর মত চলাফেরা করত। অনেকটা ঢেউয়ের মতই তারগুলি ওঠানামা করত। আমি মনদিয়ে দেখতাম। এইভাবে সময় কেটে যেত। মাঝে মাঝেই তারে বসে থাকত লম্বা লেজওয়ালা একধরণের পাখিবাবা শিখিয়েছিল ওটার নাম ফিঙেলেজ লম্বা থাকার জন্যে ওরা মাটিতে নামতে পারত না। কী বিড়ম্বনা।
অনেকটা পথ এইভাবে পেরিয়ে যাবার পর, বাড়িঘর দেখা যেত। একই রাস্তাদিয়ে বারবার যাতায়াত করার ফলে বাড়িগুলো সব চেনা হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির গড়ন দেখে বুঝতাম আর কতদূর বাকী আছে। একটা নিজস্ব জগতে ঘোরের মধ্যে ছিল আমাদের সেই ভ্রমণ। তারপর তো অনেক ঘুরলাম, কিন্তু ছবির মতন মনে আছে আমার সেই ছোটবেলার মামাবাড়ি ভ্রমণ। অনেকগুলো বাড়ি কাঠের ছিল। সেইসব কাঠের গায়ে আলকাতরা মাখিয়ে রাখা হত, বৃষ্টি ও ঘূণের থেকে বাঁচানোর জন্যে। এইরকম বাড়ি কখনও দোতলাও হত। তার উপর থাকত টিনের চাল। এরপর একটি নদী পার হতাম ব্রীজের উপর দিয়ে, নদীর নাম ছিল ‘কালজানি’। সাধারণত এইসব নদীগুলি শান্তই থাকত কিন্তু বর্ষার সময় যখন পাহাড়ে বৃষ্টি হত তখন ‘গেল-গেল’ রব উঠত। একবার এইরকমই পাহাড়ি বৃষ্টির ফলে ভীষণ ক্ষতিকারক বন্যা হয়েছিল। অনেক বাড়ি ডুবে গিয়েছিল। শহরের সবচেয়ে উঁচু ছিল প্রধান রাস্তাটিআর প্রধান রাস্তার থেকে গলিগুলো সব নীচের দিকে নেমে যেত। বন্যায় ওই প্রধান রাস্তাটাও ডুবে গিয়েছিল। তবে আমাদের মামাবাড়ি কাঠের দোতলা ছিল বলে উপরতলা আমার দিদা আর তার মাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সাথে কিছু পাড়ার লোকজনও আশ্রয় নিয়েছিলেন। বন্যার পরে আমরা গিয়েছিলাম। ধবধবে সাদা আঠার মত এঁটেল মাটিতে সব ঢেকে গিয়েছিল। জল নেমে যাবার পর ওই মাটিগুলো শক্ত হয়ে আসছিল। বন্যার থেকেও ওটা ছিল বেশী বেদনাদায়ক। পরিষ্কার করা এক দানবীয় ব্যাপার ছিল। অনেক জিনিস নষ্ট হয়েছিল এই মাটির প্রকোপে। এই বন্যা কেড়ে নেয় আমার শৈশবের স্মৃতি। আমাদের মামাবাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়। দিদাদের আমরা আমাদের কাছে নিয়ে আসি। তারপর আর কোনোদিন ওই ভ্রমণ করিনি।       
ওইসব এলাকায় ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ত শীতকালে। পুরানো হয়ে যাবার ফলে কাঠের দেয়ালগুলি ফাঁকা হয়েগেছিল। ফলে সকাল সকাল প্রচুর ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকত, আর আমরা লেপের তলায় গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকতাম। আর ছিল সেইসব খাবারের হাতছানি যেগুলো বাড়িতে হতনা। তারপর দিদার সাথে বাজার। আমার দিদা ছিলেন কিঞ্চিৎ খাদ্যরসিক। মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে থাম্পস্‌-আপ পান করতাম। তখন ওটাই ছিল রাজা। আর কখনও লুচি-সব্জি। যেহেতু বড় রাস্তা এই শহরের প্রধান ব্যাপার ছিল তাই সমস্ত দোকানই এর ধারে গড়ে উঠেছিল। যেসব জায়গায় নীচু জমি ছিল সেখানে দোকানগুলো বড় বড় থামের উপর তৈরী করা হয়েছিল। রাস্তার ধারে ঠিক একটা ডোবার উপর একটা দোকান দাঁড়িয়ে থাকত। ওইরকম দোকান সচরাচর দেখা যায়না। আর দিদার সাথে গেলে আরও একটি পাওনা ছিল, তা হোল গিয়ে রিক্সায় চড়া। রিক্সাটা যখন বড় রাস্তার থেকে গলিতে ঢুকত তখন তার গতি বেড়ে যেত উপর থেকে নিচে নামার জন্যে। গতিবেগের আর এক নাম রোমাঞ্চ। আর ছিল আমার দিদার বাবার হোমিওপ্যাথির দাতব্য চিকিৎসালয়। আমার সেই মিষ্টি ওষুধ খাবার লোভে অসুখ করত। বড়দাদুর কাছ থেকে আমি মিষ্টি পুরিয়া খেতাম।
মামাবাড়ি থেকে ভুটান ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ছিল। কথায় কথায় আমরা একসময় বিদেশ ভ্রমণ করেছি। ছোটমামা এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। ছোটমামা তার যৌবনে ভুটান রাজার অধীনে চাকরি করতেন। ওটা মামার নস্ট্যালজিয়া ছিল। আমরা বারবার যেতাম। তখন কোন পাসপোর্ট লাগত না, এখনও লাগে না।  
আমার মামাবাড়িতে অনেক আকর্ষণীয় জিনিষপত্র ছিল। তারমধ্যে অন্যতম ছিল, এক্কেবারে সেই পুরানো দিনের গ্রামাফোন। একটা আলমারির উপরে সেই হিজ মাস্টার্স ভয়েজ-এর মতন একটা চোঙ ছিল। আলমারিটা মূলত রেকর্ড রাখার জন্যে। আরও একটা জিনিষ ছিল, সেটা হল বর্গাকার একটি বই রাখার র‍্যাক। সেটা আবার ঘোরানো যেত। পরে আমি ওটা অনেক পুরানো বাড়িতেই দেখেছি। এইসব ছিল বাতিলের খাতায়। মামাবাড়ির দোতালায় পেছন বরাবর লম্বা বারান্দায় এইসব রাখা থাকত। তখন ছোটবেলায় এখনকার মত ভাতঘুম আসত না। সারাদুপুরের সাথী ছিল এইসব গুপ্তধন। আর ছিল প্রচুর বই। আমার মায়েরা চার ভাইবোন। তাদের পড়ার বই, গল্পের বইয়ে ভরা ছিল কয়েকটা আলমারি। আমার বই ঘাঁটাঘাটির অসুখটা মনে হয় ওইখান থেকেই এসেছে। আমি চিরকালই যত না বই পড়ি তার চেয়ে বেশি ঘাঁটাঘাটি করতে পছন্দ করি। আমি বেশকিছু বই ও রেকর্ড নিয়ে এসেছিলাম। তারমধ্যে কিছু দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাসংখ্যা ছিল। লেখকের তালিকাটা বেশ লোভনীয়। সেরা শিশুসাহিত্যিকেরা তখন ওখানে লিখতেন। আজও আছে আমার কাছে সেইসব বই।               
আমার স্মৃতিতে বই, রেকর্ড আর কাটানো সময়গুলি বড়ই প্রিয়। আজও আমি যদি কোথাও ফিঙে দেখি আমার স্মৃতিতে একের পর এক ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে। আমি মানসচক্ষে আবারও ঘুরে আসি। আমি দেখতে পাই সেই দিগন্ত জোড়া ধানক্ষেত, টেলিগ্রাফের তার, ফিঙে পাখি। সেই অলস ব্যস্ত দুপুর, শৈশবের গুপ্তধন আর কল্পনার রাজ্য।

আজ টেলিগ্রাফের তারও হয়ত খুলে ফেলা হয়েছে। ফিঙে অনেক আগেই কমে এসেছিল। সেই তারও নেই সেই ফিঙেও নেই। আমার মামাবাড়িও কেবল স্মৃতি। আমার বয়স বাড়বে আমি অনেক কিছুই হয়ত ভুলে যাব কিন্তু এই স্মৃতি আমাকে হয়ত মিঠে তাড়া করে বেড়াবে সারাজীবন। 

Comments

Popular posts from this blog

ভিনসেন্ট ভ্যানগখ এর সাথে

ডাচ গোল্ডেন এজ, রেমব্রান্ট ও নাইট ওয়াচ