পাম-দা কেমন আছেন ?

আরে পাম-দা'কে চেনা আছে? সেই পামদা যে কিনা লেডি বার্ড সাইকেল নিয়ে মেয়েদের স্কুলের সামনে ঘুরঘুর করত স্কুল লাইফ থেকেই। পাম-দার ছোটবেলার থেকেই একটা বদ অভ্যাস ছিল পান খাওয়ার। সেটা আবার বেশি খয়ের ও চুন দিয়ে খেত বলে কথা বলার সময় পামদার মুখ থেকে লাল রক্তের মত রস গড়িয়ে পড়ত। সেই দেখে পামদাকে একটি মেয়ে বলেছিল, তোমার আমাদের মত মেয়ে নয়, ভৈরবী দরকার।  তুমি তন্ত্রসাধনা কর।  পামদা সেই থেকে যে মেয়েদের স্কুলের সামনে ঘুরঘুর করা বন্ধ করেছিল তারপর আর ওইমুখো হয় নি।  তবে পামদা লেডি বার্ড সাইকেলটা ছাড়েনি। সেটা তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিল।

সেই পাম-দা'র সাথে রেলের দীর্ঘদিনের এক অম্লমধূর সম্পর্ক ছিল। বেশকিছু ঘটনা ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। আজ কিছু স্মৃতিরমন্থন করা যাক।

পাম-দা'র এক হরিহর আত্মা বন্ধু ছিল। সে সুদূর ব্যাঙ্গালোরে পড়াশোনা করত। পাম-দা সারাবছর বিরহ যন্ত্রনার মধ্যে কাটিয়ে পুজার ছুটির আগে অপেক্ষা করত কখন সে আসবে। এর মধ্যে সমকামী প্রেমের কোন গন্ধ ছিল না। আজ থেকে অন্তত কুড়ি বছর আগে ব্যাপারটা ফেসবুকের মতই প্রায় অজানা ছিল। পাম-দা সেই বন্ধুকে আনতে এবং ছাড়তে স্টেশনে অবশ্যই যেত। ছাড়তে যাবার ব্যাপারটা দেখার মত ছিল। পাম-দার মত আরও গোটা বিশেক বন্ধুবান্ধব মিলে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের ভেতর মালপত্র নিয়ে উঠত। তারপর হুড়োহুড়ি করে নেমে আসত শেষ মুহুর্তে। তা একবার গল্পের ছলে সময় এতটাই গড়িয়ে গেছিল যে ট্রেন কখন ছেড়ে দিয়েছে কেউ খেয়াল করেনি। পাম-দা তার প্রেমিক বন্ধুর বিরহে এতটাই কাতর ছিল যে বের হতে হতে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। যতক্ষণে পাম-দা ট্রেনের দরজার কাছে পৌঁছতে পেরেছিল ততক্ষণে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে। পাম-দা মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে লাফ দিয়ে নেমে পড়বে। ট্রেন তখন একটা ডোবার পাশদিয়ে যাচ্ছিল। ডোবা নিয়ে পাম-দার অন্য গল্প আছে। সেটা পড়ে বলব। তা পাম-দা যেই লাফ দিতে যাবে, পেছন থেকে বেশ শক্তিশালী একজন জড়িয়ে ধরে পাম-দাকে ভেতরে টেনে নিয়ে আসে। তারপর পাম-দার উপর বর্ষিত হতে থাকে জ্ঞানবৃষ্টি। এত অল্পবয়েসে কীসের বেদনা সেই নিয়ে আধ্যাত্মিক আলোচনাসভা চালু হয়ে যায়। সেটা ছিল দূরপাল্লার ট্রেন আর পরের ষ্টেশন তিনঘণ্টা পরে। পাম-দার পকেটে একটি টাকাও নেই আর মোবাইল শব্দটাই সেইসময় কারও জানা ছিল না। পাম-দা লজ্জায় না পারছে ফিরে যেতে তার বন্ধুর কাছে, আর উদ্ধারকারীরাও তাকে ষ্টেশনে না নামানো পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের কেউই ভরসা করতে পারেনা। 

পাম-দা ইমোশনাল। একটু নয় বেশি পরিমানেই ইমোশনাল। পাম-দা একসময় নিয়মিত ডায়েরি লিখত। সেই তন্ত্রসাধনার ঘটনাটা ঘটার পর থেকেই পাম-দা’র ডায়েরি লেখা চিরকালের মত বন্ধ হয়ে যায়।  তারপর পাম-দা তার ডায়েরিগুলি শশ্মানে চিতায় পুড়িয়ে আসে। পাম-দা’র কথা অনুযায়ী ডায়েরিগুলি না বলা পাম-দাই। এর সৎকার না হলে আত্মার শান্তি হবে না। পাম-দা এইভাবেই অর্ধেক হয়ে গেলেন। আর সেই ডায়েরিগুলির সাথে মানবসভ্যতার কী সম্পদই না হারিয়ে গেল তা বিধাতাই জানেন। ডা-ভিঞ্চির ডায়েরির কয়েকটা পাতা তাও ফিরে এসেছিল, পাম-দার ডায়েরিগুলি আর ফিরে আসবে না। পাম-দাও আর ডায়েরি লিখবেন না বলে মনস্থির করলেন। এমনকি পুলিশের চাকরিও করবেন না বলে ঠিক করলেন। কারন পুলিশের চাকরি করলে সেখানেও ডায়েরি লিখতে হবে যে। প্রশাসন পাম-দা’র মত একজন পুলিশ হারাল। তাই তো আমরা আজকে এত অসহায়।  

এইরকম নানাবিধ গল্প আছে পাম-দা'র যা এক বৈঠকে শেষ করা যাবে না।  পাম-দা একবার ইন্টারভিউ দিতে কলকাতা গেছে। সাধারণত টিকিট না কেটেই ট্রেনে চড়ার অভ্যাস। যেহেতু সরকারি চাকরির ইন্টারভিউ, সরকার থেকে বিনে পয়সায় টিকিট দেয়। তা পাম-দা'র কনফিডেন্স ভেঙ্গে পড়া ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের থেকেও উত্তুঙ্গে। সকাল সকাল শিয়ালদা স্টেশনে নেমে দেখে দূরে ঘুম চোখে এক কালো কোট পড়া টিকিট চেকার। তিনি বেছে বেছে যাত্রীদের থেকে টিকিট চাইছেন। পাম-দা'র কাছে একটি ব্যাগ ছিল। তা হাতে নিয়ে পাম-দা ধীর গতিতে চেকারের দিকে হাঁটা দিলকাছাকাছি আসতেই পাম-দা উসেইন বোল্টের গতিতে উল্টো দিকে দৌড়ান শুরু করল। চেকার মাথা নীচু করে টিকিট চেক করছিল। তার ব্যাপারটা বুঝতে বেশ কিছু সময় লাগল। বোঝার সাথে সাথেই চেকারও পেছন ধরল। পাম-দা প্ল্যাটফর্মের যেদিকে দৌড়াচ্ছিল সেদিকে উঁচু পাচিল। চেকারের শিকার নিশ্চিত ভেবে ঘুম চোখেও পড়িমড়ি করে দৌড়াচ্ছিল। বেশকিছুটা দৌড়ে পাম-দা দাঁড়িয়ে পড়ে।
চেকার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বেশ গম্ভীরভাবে বলে, 'চল শালা, সক্কাল সক্কাল হেদিয়ে মারলে।'
পাম-দা বেশ গম্ভীরভাবে বলে ওঠে, 'এক্সকিউস মি?'
চেকার রীতিমত বিরক্ত হয়ে বলে, 'স্বভাব খারাপ, টিকিট কাটলেই তো হয়। পোশাক দেখে তো মনে হয় না এত খারাপ দশা।'

পাম-দা বেশ নির্লিপ্তভাবে পকেট থেকে টিকিট বের করে চেকারের দিকে এগিয়ে দিলে চেকারের মুখটা বিশাল হা হয়ে যায় যা বিশ্বরূপ দর্শনের চেয়ে কোন অংশে ছোট নয়। অত্যন্ত নীচুমানের গালি দিতে দিতে চেকার জিজ্ঞেস করে, 'তা দৌড়াচ্ছিলিস কেন?'
- সকালে এক্সারসাইজ করি, তাই ভাবলাম ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে একটু দৌড়ে নিই। কোন অসুবিধে?


এই হোল আমাদের পাম-দা। 

Comments

Popular posts from this blog

ভিনসেন্ট ভ্যানগখ এর সাথে

ডাচ গোল্ডেন এজ, রেমব্রান্ট ও নাইট ওয়াচ