বিবলিওম্যানিয়াক (Bibliomaniac)

Bibliomania একটি মজার শব্দ। এরমানে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় যে বই কিনতে ভালবাসে। বই কেনার ভালোবাসা যার প্রায় পাগলামির পর্যায়ের। পথচলতি বইয়ের দোকান দেখলেই আর থাকতে পারেন না। ঢুকে পড়েন উদ্দেশ্যহীন ভাবে। হয়তো কিনেও ফেলেন বেশকিছু বই। আসল যে জিনিষ কেনার কথা ছিল তাঁর সাথে আপোষ করে বই কিনে বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে বই রাখা জায়গা নেই তাও কিনে চলেছেন। সব বই হয়ত পড়াও হয়নি তাও কিনছেন। আপনার বই কেনার সাথে বইপড়া সমানুপাতিক হারে নিম্নগামী। এইটুকু শুনে অনেকেই মুচকি মুচকি হাসছেন। মিল পাচ্ছেন তো? আমিও এইরকমই মিল পেয়েছিলাম বলেই এতগুলি কথা বললাম। কথাটা যখন প্রথম শুনি বেশ মজা পেয়েছিলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি বিবলিওফিলিয়া বা বইপোকার সাথে এর আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে। Bibliomania একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি। আর এই ব্যাধিগ্রস্তদের বলা হয় Bibliomaniac  জন ফেরিয়ার (১৭৬১ - ১৮৫১) নামে একজন  Manchester Royal Infirmary -র জেনারেল ফিজিসিয়ান এই শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেন তাঁর বন্ধু রিচার্ড হেবারের উদ্দেশ্যে। পূর্বে এর ব্যবহার ছিল সেইসব মানুষদের জন্যে যারা মূলত সাজিয়ে রাখার জন্যে বই কিনতেন। আজও ইউরোপের ক্যাসেলগুলির ভেতরে এইরকমের লাইব্রেরি দেখা যায় যার মালিকানা একজনের ছিল। মরক্কো চামড়ায় বাধানো সোনালি কালি দিয়ে বইয়ের মলাটে তাঁর মালিকের নাম লেখা থাকত। এগুলি কেবলমাত্র দেখানোর জন্যে কেনা হোত। পড়া হোত না বললেই চলে। আমি এক উপন্যাসে পড়েছিলাম এক বাটলার তাঁর মালিকের লাইব্ররীর বই লুকিয়ে পড়ার অপরাধে চাকরি খুইয়েছিল। আধুনিক যুগের কফিটেবল বুকের মতই এগুলি কেবল শোভাবর্ধন করত।

এবার আসি বইচোরদের অধ্যায়ে। এঁরাও বিবলিওম্যানিয়াকদের দলে পড়েন।  ইতিহাসে এইধরণের মানুষদের নানা তথ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ইতিহাস খ্যাত এইসব বইচোরদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন স্টিফেন ক্যারী ব্লুমবার্গ বলে একজন। আমেরিকার আইওয়াতে বসবাসকারী স্টিফেন ধরা পড়েছিলেন মোট ২৩,৬০০ বই চুরি করার দায়ে। যার বর্তমান মূল্য ১০ মিলিওন ডলার বা ৭৬ কোটি ভারতীয় টাকা প্রায়। এর চুরিকরা অমূল্য সব বই নিয়ে একখানা লাইব্রেরী আছে। স্টিফেন চুরি করতেন অদ্ভুত সব উপায়ে। সেন্ট পলস শহরে পুরানো ভিক্টোরিয় বাড়িগুলিতে দরজা জানালা মেরামতের মিস্ত্রী ছিলেন। সেই ফাঁকে এক-দুখানা করে বই চুরি করতেন। প্রথমে মূলত চুরি করতেন নিজের সংগ্রহের জন্যে। পরে তা নেশায় পরিণত হয়। তিনি আমেরিকার বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রারি থেকে চুরি করেছেন। উইকেন্ডে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন আর ফাঁকা বাড়ি দেখলেই সেখানে ঢুকে বই চুরি করতেন। স্টিফেনের সংগ্রহে বহু অ্যান্টিক জিনিষ ও পাওয়া গেছে।

ডঃ এলোয় পিচলার নামে এক পাদ্রী যিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের রাশিয়ান ইম্পিরিয়াল লাইব্রেব্রি থেকে ১৮৬৯ - ১৮৭১ র পর্যন্ত মোট ৪০০০ বই চুরি করেন। এই সময় ইনি সেখানে চাকুরিরত ছিলেন। ইনি প্রতিদিন কাজে আসতেন বেশ বড়সড় ওভারকোট পরে যার ভেতরে বড় বড় পকেট থাকত। যার মধ্যে বই ভরে প্রতিদিন ইনি বাড়ি নিয়ে আসতেন। পরবর্তিকালে ধরাও পড়েন।

আবার বই সংগ্রাহকদের মধ্যে টমাস ফিলিপ নামে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক ব্যারন ছিলেন। ইনি উত্তরাধিকার সুত্রে বহু টাকার মালিক হন যা পুরোটাই শেষ করে ফেলেন বই কিনে। টাকা শেষ হয়ে গেলে ইনি ধার করা শুরু করেন। ধার করতেন কেবলমাত্র বই কেনার জন্যে। পড়াশুনা করেছেন অক্সফোর্ডে এবং রয়াল সোসাইটি অফ ফেলোর ও সদস্য ছিলেন। ছোটবেলায় এনার স্বপ্ন ছিল পৃথিবীর সমস্ত বইয়ের মালিকানা নেবার। আদপে তাঁর মৃত্যুর সময় ৪০,০০০ ছাপা বই ও ৬০,০০০ পার্চমেন্ট পুঁথি পাওয়া গেছে। ইনিই সেরা পুস্তক সংগ্রাহক।

আমি আমস্টারদামে ক্যানালের ধারে কারোর বাড়ীর গেটের গায়ে ছোট বই রাখার যায়গা দেখেছি। কেউ নেই। বই নিয়ে পড়তে পারেন আবার বদ্‌লে একটা অন্য কোন বই যা আপনার পড়া হয়ে গেছে তা রেখে যেতেও পারেন। কেউ কিছু বলার নেই। এইরকম একটা লাইব্রেরী মেলবোর্নেও দেখেছি। যখন কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে চাকরি করতাম তখন শুনেছি লাইব্রেরী থেকে বই চুরি একটা সমস্যা। এই নিয়ে লাইব্রেরী সাইন্সে রীতিমত পড়াশুনা হয়।
Melbourne Little Library

বই চুরি অনেকরকম হতে পারে। যেমন সমুদ্রতীরে অনেকেই বই নিয়ে যায়। সেই বই পড়তে পড়তে হয়ত গা ভেজানোর জন্যে কেউ একটু জলে নামল ব্যাস বই গায়েব। সেই বই হয়ত পরে কোন ফুটপাতে বই বিক্রেতার কাছে পাওয়া যাবে। স্কুল কলেজে বই নিয়ে বই ফেরত না দেওয়ার ঘটনাও কম নেই। প্রত্যেকের এই দুইপক্ষে থাকার অভিজ্ঞতাই কম বেশি আছে। বইয়ের দোকান থেকে বইচুরি করাকে অনেকে  বিবলিওক্ল্যাপ্টোম্যানিয়াক (bibliokleptomaniac) বলে। জানি না আদপে এই কথাটার অস্তিত্ত্ব আছে কিনা। তবে পরিচিত এক শব্দের অনুকরণে।

মাইক্রোসফটের বর্তমান সিইও সত্য নাদালা বলেছিলেন যে তিনি যতগুলি বই কেনেন তত বই পড়ে উঠতে পারেন না। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে। তবুও বই কেনায় বিরাম নেই। আবার অনেকে তেমন বই না কিনলেও বই পড়েন প্রচুর। লাইব্রেরী থেকে লাইব্রেরী চষে বেড়ান। এরা বইয়ের মালিকানায় বিশ্বাসী নন। বিল গেটস সারাবছর ধরে অনেকগুলি করে বই পড়েন। বিল গেটসের ব্লগে তিনি তাঁর পছন্দের বইগুলি সম্মন্ধে লেখেন। এক ধাক্কায় সেইসব বইগুলির বিক্রি বেড়ে যায়। বিল গেটসের রিভিউ পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার।


বই নিয়ে পাগলামী আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও এই নিয়ে ভাববার ব্যাপার আছে।।

  • ঋজু  ঘোষ, ১৬ এপ্রিল ২০২০, ব্যাঙ্গালোর

Comments

Popular posts from this blog

ভিনসেন্ট ভ্যানগখ এর সাথে

ডাচ গোল্ডেন এজ, রেমব্রান্ট ও নাইট ওয়াচ