ডাচ গোল্ডেন এজ, রেমব্রান্ট ও নাইট ওয়াচ
হল্যান্ড বা অধুনা নেদারল্যাণ্ডের শিল্পকলা
পশ্চিম দুনিয়ার ইতিহাসে এক গুরুত্ত্বপূর্ণ অধ্যায়। ডাচ শিল্পের ইতিহাস একটু
অন্যরকম বাকী আর সব সমকালীন বা পাশাপাশি দেশের শিল্পের ইতিহাসের তুলনায়। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স
ইত্যাদি দেশের থেকে ডাচ শিল্পের ধারা একটু অন্যরকম। ডাচ শিল্পের সেরা সময়কে তাই
আলাদাভাবে "ডাচ গোল্ডেন এজ" বলা হয় যা মূলত
ষোড়শ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী অব্দি বিস্তৃত ছিল। ডাচ শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই
বেশ নাম করা। ফ্রান্স হালস, রেমব্রান্ট, ভেরমেয়ার, ভ্যানগখ
ইত্যাদি। এরা সকলেই কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা গেছেন। এদের মধ্যে সেরা হলেন
রেম্ব্রান্ট। বাংলা সাহিত্যে যেমন রবীন্দ্রনাথ তেমনই ডাচ শিল্পকলায় রেমব্রান্ট।
একে ছাড়া ডাচ শিল্পের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। রেমব্রান্ট সারা জীবনে প্রচুর ছবি এঁকেছেন, কিন্তু
তাঁর "নাইট ওয়াচ"
এমন এক কীর্তি যার জন্যে
রেমব্রাণ্টকে সারা দুনিয়া মনে রাখবে। রেমব্রান্ট দক্ষ ছিলেন পোর্ট্রেট ও এচিং-এ।
তিনি প্রচুর পোর্ট্রেট এঁকেছেন। যে পরিমান নিজের পোর্ট্রেটও এঁকেছেন তাও দেখার মত। আমি এমন একজনের সাথে পরিচিত যিনি
তাঁর সারাজীবন সমর্পণ করেছেন কেবল রেমব্রান্টের সেলফ পোর্ট্রেটের প্রতি। ডাচরা
সাধারণত ব্যবসায়ী জাত হলেও নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের রোমান্টিক
বিলাসিতায় এরা বাঙ্গালিকেও হার মানায়। রেমব্রান্টের বিভিন্ন বয়েসের ছবিগুলি দেখলে
বোঝা যায় শেষ জীবনে গভীর বিষণ্ণতা তাঁকে কিভাবে গ্রাস করেছিল। শেষ জীবনে
রেমব্রান্টের মত শিল্পীও আঁকার বরাত পেতেন না, ধারদেনা এমন গভীরে
পৌঁছেছিল যে তাঁর সাধের সংগ্রহ ও বাসস্থান নিলামে উঠেছিল। রেমব্রান্টের সংগ্রহে
বেশ কিছু মুঘল মিনিয়েচার ছিল। তাঁর স্কেচবুকে কিছু মুঘল মিনিয়েচারের কপি পাওয়া
যায়। এছাড়াও রেমব্রান্ট তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের ছবিও কিনতেন। তাঁর প্রিয় স্ত্রী
মারা যাবার পর তিনি বাড়ির পরিচারিকার সাথে প্রণয়পাশে আবদ্ধ হন, তাঁদের
সন্তানও ছিল। শেষ জীবনে নিঃস্ব হয়ে এদের আশ্রয়েই তাঁর বাকীজীবন কাটে। দ্যা ভিঞ্চির
মোনালিসার মতই গুরুত্ত্বপূর্ণ এই "নাইট ওয়াচ"। আমরা এই ছবি ও তার সমসাময়িক ডাচ সমাজের দিকে
একটু চোখ বোলাব।
রেমব্রাণ্ট
যে সময় এই ছবি একেঁছিলেন সেই সময়টা জানা জরুরি। সময়টা বলা হয় "ডাচ
গোল্ডেন এজ"। নেদারল্যাণ্ড তার জলপথে ব্যবসা বাণিজ্য ছড়িয়ে
ফেলেছে। প্রচুর টাকা পয়সা সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের হাতে। ডাচরা সধারণত প্ররিশ্রমী
জাত। এদের মধ্যে জমিদারি মনোভাব নেই। কেউই তাদের বাপ ঠাকুরদার সম্পত্তিতে বড়লোক
নয়। এর মূল কারণ দুটো - এক ডাচরা পারিবারিক রাজতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত
নয়। দুই - এদের জমিজমা প্রায় কিছুই ছিল না। যাও বা ছিল তাও
জলাভূমি। এছাড়াও আরও একটা কারণ হল ডাচরা দীর্ঘদিন স্পেনের অধীনে ছিল। তাই সম্পদের
মূল স্পেনের কোষাগারেই জমা পড়ত তাই সাধারণ প্রজার আর বড়লোক হওয়া হয়ে ওঠে নি।
আশেপাশের দেশগুলির দিকে তাকালে অজস্র ক্যাসেল দেখা যায়, দেখা
যায় মাইলের পর মাইলজোড়া জমিসহ অট্টালিকা। ডাচদের সেরমকম কিছুই নেই। বরং সেই সময়
যখন বাকী ইউরোপে সবাই পেল্লায় বাগানঘেরা বাড়ি বানাচ্ছে তখন ডাচরা ডল হাউসের মত
ছোটছোট গায়ে লাগানো খুপড়ি বানিয়ে চলেছে। যা আজও দৃশ্যমান আমস্টারডাম শহরে।
ক্যানালের ধারে সেই বাড়িগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল জলপথে বাণিজ্য থেকে ফেরা জাহাজগুলি
থেকে মাল জমা রাখার গুদাম হিসাবে। তাই বাড়িগুলির উপরে দেখা যায় হুক লাগানো আছে। আর
বাড়িগুলিও সামনের দিকে ঝোঁকা যাতে মাল তোলার সময় তা দেয়ালে ঘেঁষে না যায়। ছোট ছোট
ডল হাউসের মত বাড়িগুলি আজও আমস্টারডামের মূল আকর্ষণ। যে কারনে আমস্টারডাম শহরকে
ইউনিস্কো হেরিটেজ সিটির আখ্যা দিয়েছে।
এতগুলি
কথা বললাম এটা বোঝানোর জন্যে যে তখনকার আমস্টারডামের আর্থসামাজিক অবস্থা কী রকম
ছিল। আজকের দিনে আমস্টাডামে যে রাজবাড়ি
(আগে টাউন হল ছিল) আছে
তা মূল শহরের কেন্দ্রে। যা কিনা এক্কেবারে রাস্তার ধারে। অন্যান্য যেকোন রাজবাড়ি
বা জমিদার বাড়িগুলিতে যেতে গেলে বেশ কিছুটা পথ পার হতে হয় যার দুপাশে বাগান থাকে।
এই রাজবাড়ি দেখলে মনে হবে নিতান্তই কেজো কোন অফিস বাড়ি। যদিও বর্তমান রাজা এখানে
থাকেন না। এটা এখন মিউজিয়াম হিসাবেই ব্যবহার করা হয়। এর কোন প্রাচীর নেই, নেই
মোরাম বিছানো পথ। ডাচরা তাদের দেশের প্রায় ৭০% জমি নিজেরাই বানিয়েছে।
বানিয়েছে বলতে গেলে নীচু জলা জমি ধীরে ধীরে মাটি দিয়ে ভরতি করে তাতে বসত, ক্ষেত
ইত্যাদি তৈরি করেছে। আজকের স্কিফল
(Schiphol)এয়ারপোর্ট যা
নেদারল্যান্ডের একমাত্র ও ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট সমুদ্র সমতলের থেকে প্রায় ৬ মিটার
নীচে। আজও জলা জমির কারিগরি দক্ষতায় ডাচরাই পৃথিবীর সেরা। তাই যেখানেই জলা জায়গা
নিয়ে সমস্যা থাকে সেখানেই ডাচদের ডাক পড়ে। সে দুবাইয়ের কৃত্রিম পামবিচ তৈরি বা
অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরের ঝিলের মাটি পরিস্কার করা যে কোন জলীয় সম্পদের ব্যাপারেই
ওরা সমান দক্ষ। আমার মনে হয় মঙ্গলে জলের সন্ধান পেলে প্রথমেই ডাচদের ডাক পড়বে।
ডাচরা যখন স্পেনের সাথে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করছিল যা বহু বছর ধরে চলেছে তার
মাঝে মধ্যেই পারিবারিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে যা মূলত সফল হয় নি।
এমনকি যিনি স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার মূল
দাবিদার ছিলেন। কিন্তু তিনিও মধ্যবিত্তদের মতই তাঁর জীবন কাটিয়েছেন। "বাবার
জমিদারি" শব্দটা বোধ হয় ডাচ ভাষায় পাওয়া যাবে না। তাই
নেদারল্যান্ড বহুদিন আগে থেকেই একটি রিপাব্লিক।
যেকোন
দেশের শিল্পের ইতিহাস বলতে গেলে যেটা জানা জরুরি তা হল শিল্পে অর্থের জোগান।
শিল্পীর পেট না চললে শিল্পে বিপ্লব আসে না। এই শিল্পীরা সেই সময়ে আজকের চিত্রকরদের
মতই ছিলেন। যাঁরা ঘরদোর সাজানোর জন্যে ছবি আঁকা ছাড়াও প্রচুর পোর্ট্রেট এঁকেছেন যা
মূলত তাদের জীবিকা নির্বাহ করাতো। ইউরোপের রেঁনেসার মূলধারা চালু হয়েছিল চার্চের
আনুগত্যে। চার্চগুলি খ্রিস্টের বাণী ও বাইবেলের কাহিনীগুলি চিত্রকরদের দিয়ে আঁকিয়ে
নিত। তাই সেই সময়কার সমস্ত সেরা শিল্পীর ছবিগুলি ধর্মীয় কাহিনী অবলম্বনেই। কারণ
পয়সা আসত এইসব চার্চগুলি থেকে। আবার স্পেনে দেখা যায় প্রচুর পোর্ট্রেট নিয়ে কাজ
করেছের গয়্যা বা গেয়া (Goya)। নেদারল্যান্ড স্পেন থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর
প্রোটেস্টান মতাবলম্বী হয়ে ওঠে। এর ফলে চার্চগুলিতে ভীড় কমতে থাকে। যার ফলে চার্চ
যা মূলত চলে ভক্তদের পয়সা দিয়ে তা বন্ধ হয়ে আসে। এখন আমস্টাডামে গেলে দেখা যায় বেশ
কিছু চার্চ গ্যালারিতে পরিণত হয়েছে নয়ত শুঁড়িখানা হয়ে গেছে। ভাবতেই অবাক লাগে। না
দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। মোদ্দাকথা হোল ডাচ শিল্পীরা চার্চ থেকে কোন কমিশন পেতেন
না। তাই তাদের পেট চলবে কেমন করে? যদি শিল্পীরা কাজ না পান তবে তাঁরা দলে দলে পাড়ি
দেবেন শিল্পের কদর যেখানে আছে সেই সব জায়গায় যেমন ইটালি, ফ্রান্স
বা রাশিয়ায়। স্পেন কদাচ নয়। কারণ স্পেন তো তাদের শত্রু। তখন সবে নেদারল্যাণ্ড
স্পেন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হয়েছে।
এইরকম
একটা সময় রেমব্রান্ট ২৫ বছর বয়েসে আমস্টারডামে ভাগ্যান্বেষণে আসেন। বলা বাহুল্য যে
তিনি নেদারল্যাণ্ডের বাইরে কখনও পা রাখেন নি। কিন্তু রেমব্রান্টের ছবিতে সেই
সময়কার বিখ্যাত শিল্পীদের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। যদিও রেমব্রান্ট সেইসব প্রভাব
থেকে বেড়িয়ে এসে এক স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। রেমব্রাণ্ট যে সময় ছবি
আঁকছিলেন সেই সময়ে পোর্ট্রেটের খুব কদর। এছাড়াও গ্রুপ পোর্ট্রেটের এক অনন্য ধারা
শুরু হয়েছিল নেদারল্যান্ডে। এই গ্রুপ পোর্ট্রেটের ব্যাপারে কিছু কথা বলি - দীর্ঘ
যুদ্ধের পর নেদারল্যাণ্ড তখন স্পেন থেকে স্বাধীন হয়ে নিজস্ব ব্যবসা বাণিজ্যের
দ্বারা সমৃদ্ধিতে ভরে উঠেছে। জলপথে একের পর এক কলোনি তাদের দখলে চলে আসছে। এরফলে
সাধারণ মানুষের হাতে বেশ কিছু পয়সা জমে উঠছে যা তাদের থাকা খাওয়া বাদ দিয়ে উদবৃত্ত
থেকে যাচ্ছে। এক কথায় সেই সময় নেদারল্যান্ডে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকের সংখ্যা
প্রচুর। এরা স্বভাবতই নিজেদের ছাপ রেখে যেতে চাইছে। সেই সময় যেহেতু পোর্ট্রটের কদর
বেশি তাই নামকরা পোর্ট্রেট শিল্পীরা নেদারল্যাণ্ডে তাঁদের অমর সৃষ্টি করে চলেছেন।
যেহেতু এরা সকলেই বিখ্যাত তাই এদের দিয়ে পোর্ট্রেট বানানো খরচ সাপেক্ষ। কিন্তু
সকলেই চায় কিভাবে এইসব শিল্পীরা তাঁদের ছবি আকঁবে অথচ খরচও ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই
থাকবে। ব্যবসায়ী জাত তাই এরা ভেবে উপায় বের করল যদি কোয়াপোরেটিভ পদ্ধতিতে ছবি
আঁকানো যায়, মানে অনেকে মিলে পয়সা জড়ো করে একজন বিখ্যাত
শিল্পীকে দেবে সকলের ছবি আঁকার জন্যে। সেই ছবিটি অবশ্যই গ্রুপ পোর্ট্রেট হবে। এখন
সকলের সামর্থ্য এক নাও হতে পারে, কেউ বেশি বা কেউ কম টাকা দেবে। তাই কে কত দিল
সেই হিসাবের ভিত্তিতে ঠিক হবে সেই গ্রুপ পোর্ট্রেটে কার কোথায় স্থান হবে। সিনেমা হলের টিকিটের মত, বেশি
পয়সা মানে ভালো জায়গা। মধ্যমণি যিনি থাকবেন তিনি হয়ত সবচেয়ে বেশি পয়সা দিয়েছেন বা
তার স্তাবকেরা ছবি আঁকাচ্ছে, তার পাশে সেই সব মানুষের স্থান হবে যারা
তুলনামূলক ভাবে বেশি পয়সা দিয়েছেন। আবার ইতিহাস বলে এমনও সব গ্রুপ পোর্ট্রেট আছে
যেখানে ছবির মধ্যমণিরা বেঁচেছিলেন না যখন ছবিটি
আঁকা হয়েছে। তারা হয়ত সমাজের বেশ উঁচুপদে যেমন আমস্টারডামের মেয়রজাতীয় কোন কেউকেটা
ছিলেন। পরে তাঁদের পরিবারের লোকজনেরা পয়সা দিয়ে ছবি আঁকিয়েছে। ফলস্বরূপ দেখা যায়
সেই সব ছবিতে মধ্যমণির পাশেই যাঁরা পয়সা বেশি দিয়েছেন তাঁদের স্থান। একদম পেছনের
দিকে বা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় সেইসব ছবিগুলিতে যাঁরা কমপয়সা দিয়েছেন তাঁদের দেখা
যায়। এইভাবে নেদারল্যান্ডে গ্রুপ পোর্ট্রেটের চর্চা ছড়িয়ে পড়ে। ডাচদের মত সাধারণ
মানুষের এত অসাধারণ গ্রুপ পোর্ট্রেট আর কোথাও দেখা যায় না। কেবলমাত্র আমস্টারডাম
শহরেই
পঞ্চাশখানা গড় ১২ স্কোয়ার
মিটারের পেইন্টিং আছে। আমস্টারডামে গ্রুপ পোর্ট্রেট নিয়ে পিএইচডিও করা হয়। এইসব
শিল্পগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। একেকটা ছবি ইতিহাসের একেকটা অধ্যায় ধরে রেখেছে।
ডাচরা নিজেদের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ডাচদের ইতিহাস তেমন প্রাচীন
নয়, তাও ওরা যা পেরেছে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।
মূল
আলোচনা থেকে দূরে সরে যাবার আগে আবার ফিরে আসি আমাদের বিষয়ে। তা হল "নাইট
ওয়াচ"। আজ যদি সমস্ত নেদারল্যাণ্ড ধ্বংস হয়ে যায় আর
একজনমাত্র ডাচ বেঁচে থাকে আর তাকে বলা হয় সে কী নেবে তার সাথে, আমি
শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত তা হবে "নাইট ওয়াচ"। এইভাবে এই ছবির প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব
বোঝানো মুশকিল। এ হোল ডাচদের প্রধান জাতীয় সম্পদ। যদি ভারতের তাজমহলের সাথে এর
তুলনা করি তবে হয়ত বুঝতে সুবিধা হবে।
"নাইট ওয়াচ"ও
একটি গ্রুপ পোর্ট্রেট যা রেমব্রান্টের হাতে এক অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। ২০০
বছরের উপরে এর গুরুত্ব স্বয়ং ডাচরাও বোঝে নি। টাঙ্গানো ছিল হলের দেয়ালে। সংরক্ষণও
করা হয় নি তেমনভাবে। ধীরে ধীরে কালে কবলে এতে কালোর প্রলেপ পড়ে। বড় হবার কারণে মূল
ছবি কেটে ছো্ট করা হয়েছিল (হায়! হায়!)। সেই সময়ের ডাচ ছবিগুলিতে অন্ধকার কালো রঙের
আধিক্য দেখা যেত। কিন্তু রেমব্রান্ট এঁকেছিলেন উজ্জ্বল রঙে। কোন এক অকালপক্ক এর
উপর কালো প্রলেপ লাগায়। পরে রিস্টোরেশন করে তা উদ্ধার করা হয়। যাতে অনেকটাই আগের
ফর্ম ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। এরা খানিকটা সফলও হয়েছেন বলা যায়। এখন মূল
ছবিটা অনেকটাই উজ্জ্বল। এতেই থেমে নেই, গত শতাব্দীতে এক চাকরী হারানো শিক্ষক পাউরুটি
কাটার ছুরি দিয়ে আঘাত করে এর একদম নিচের অংশে। এতে ক্যানভাসের ৩০ সেমি মত কেটে
যায়। সেটাও ঠিক করা হয়েছে। খুব কাছে গিয়ে দেখলে তবে সেই জোড়া বোঝা যায়। এইভাবে
অজস্র অত্যাচার সহ্য করে এই শিল্প আজ ডাচদের মুকুটের মণি। রাইখস্ মিউজিয়ামের মূল
কক্ষের
প্রধান আকর্ষণ "নাইট
ওয়াচ"। ২০১৯ এর জুলাই থেকে গত কয়েক মাস ধরে এক্স-রে
ইমেজ নেওয়া হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে। এরপর হবে আর একপ্রস্থ রিস্টোরেশন।
যদি বেরিয়ে আসে কোন অজানা তথ্য। তাই গতবার গিয়ে দেখলাম কাঁচদিয়ে একে ঘিরে ফেলা
হয়েছে আর দুজন মিউজিয়াম কর্মী অতবড় ছবিটার বিন্দু বিন্দু স্ক্যান করে চলেছেন। এটা
লাইভ টেলিকাস্টও করা হচ্ছে। উতৎসাহীরা দেখে নিতে পারেন।
রেমব্রান্ট
এই ছবিটি আঁকার বরাত পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন ফ্রান্স ব্যানিং কক্ এর কাছ থেকে। কে
ছিলেন এই ক্যাপ্টেন ফ্রান্স ব্যানিং? ইনি রেমব্রান্টের সমসাময়িক। শোনা যায় এনার পিতা
বাইরে থেকে ভাগ্যান্বেষনে এসেছিলেন ও শুরুতে বাড়ী বাড়ী ভিক্ষে করতেন। পরবর্তীকালে
তিনি ওষুধের ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি করেন ও মিসেস ব্যানিংকে বিয়ে করেন। ক্যাপ্টেন
ফ্রান্স মায়ের পদবী তাঁর মধ্যনামে ব্যবহার শুরু করেন। অনুমান এই পদবীর সেই সময়
আমস্টারডামে বেশ সুনাম ছিল। ক্যাপ্টেন ফ্রান্স ব্যানিং ১৬০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন (রেমব্রান্টের
জন্মের একবছর আগে)। ইনি আইন নিয়ে পড়াশুনা করেন ও ডক্টরেট উপাধি
অর্জন করেন। এরপর তিনি ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন তৎকালীন আমস্টারডামের মেয়রের মেয়েকে।
এতে ক্যাপ্টেন ফ্রান্সের উন্নতি চরমে পৌঁছায়। ইনি বেঁচে ছিলেন ৫০ বছর বয়স অব্দি
এবং আমস্টারডামের মেয়রও হয়েছিলেন। অভিজাত সমাজে এনার যথেষ্ট কদর ছিল। মোটামুটি
১৬৩৯ সাল নাগাদ এই ছবি আঁকার বরাত দেওয়া হয় যা রেমব্রান্ট শেষ করেন ৩ বছর ধরে। মোট
সাতখানা ছবির বরাত দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন শিল্পীকে যার মধ্যে রেমব্রান্ট একটির কাজ
পেয়েছিলেন। গ্রুপ পোর্ট্রেট মানে গ্রুপ ফটোগ্রাফের মত পাশাপাশি, হয়
দাঁড়িয়ে নয় বসে থাকা অবস্থায় আঁকা হত। এটাই বোধহয় একমাত্র গ্রুপ পোর্ট্রেট যা
নাটকীয় ভঙ্গীমায় আঁকা। রেমব্রান্ট এখানে
"মোমেন্ট অফ অ্যাকশন" ধরেছেন।
এই ধরনের সাহস আগে কেউ দেখায় নি। পরেও কেউ এইভাবে আঁকতে সাহস পায় নি।
ক্যাপ্টেন
ফ্রান্স তাঁর দলের এতটা গ্রুপ পোর্ট্রেট আঁকার বরাত দিয়েছিলেন। তাঁর দলে ১২০ জন
ছিল যারা শহর পাহারা দিত। কিন্তু এই ছবিতে মাত্র ১৯ জনকে দেখা যায়। এরা মোট ১৬০০
গিল্ডার দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে যা অনেক টাকা। মূল ছবিতে ৩৫ জনের মাথা আছে।
রেমব্রান্ট এদের এনেছেন নাটকীয়তা আনার জন্যে। তাই পরবর্তিকালে এই ১৭ জনের নাম
আলাদা প্যানেলে আঁকা হয় ছবির ভেতরেই উপরের দেয়ালে। কারণ হয়ত যারা পয়সা দিয়েছিল
তারা সমান ফেস অ্যাটেনশন পায়নি বলে মনে করা হয়েছিল। অনেকেরই মুখ একপাশে ঘোরানো।
অন্য গ্রুপ পোর্ট্রেটগুলি থেকে এক্কেবারে আলাদা। এই ছবির মধ্যে একজন ড্রামার ও
একটি মেয়েও আছে। ড্রামার একজন খুবই সাধারণ গরিব, তিনি হয়ত পয়সাই দেননি
তবুও রেমব্রান্ট দৃশ্যের খাতিরে এনাকে এনেছেন। আর মেয়েটিকে অনেকে মনে করেন তাঁর
স্ত্রী সাসকীয়া যিনি সেইসময় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন। এই স্ত্রীর মৃত্যুর পর
রেমব্রান্ট মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন।
ছবির
সামনে দাঁড়ালে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় যা বলে বোঝানো মুশকিল। মনে হয় যেন কোন জীবন্ত
থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে ক্যাপ্টেন তাঁর দলকে আদেশ দিচ্ছেন আর ড্রামার
ড্রাম বাজিয়ে মার্চ শুরু করছেন। হাল্কা উজ্জ্বল আলোয় ছবির মূল নায়করা সব ব্যস্ত আর
পেছনে আবছা কতগুলি মুখ। আজকের ডিজিটাল ফটোগ্রাফির যুগে যাকে ডেফথ অফ ফিল্ড বলা হয়।
ইম্প্রেশনিস্ট জমানার অনেক আগেই রেমব্রান্ট মোটা তুলির অসমাপ্ত কাজের মাধ্যমে এক
মায়াবী পরিবেশ তৈরি করতেন। রেমব্রান্টের
"ইহুদি দম্পতি" ছবিটা
দেখলে এর উদাহরণ পাওয়া যায়। নাইট ওয়াচেও এর ছোঁয়া আছে। এই ছবি আদপেই নাটকীয়, কারণ
তখন এই ধরণের দল আর শহর পাহারা দিত না। আর পোশাক দেখলে মনে হয় এরা মধ্যযুগের
যোদ্ধা যারা ঢাল তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে। যে সময়ে ছবিটা আঁকা হয়েছিল সেই সময়
বন্দুক এসে গেছে কেউ আর ঢাল তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ করত না। আর আমস্টারডামেও তখন কোন
আক্রমণ হয় নি। তাই মনে করা হয় এ হয়তো কোন প্রতীকী মার্চ এর প্রস্তুতি। ফ্রান্সের
রাণী সেই সময় নেদারল্যাণ্ডে অবস্থান করছিলেন। হয়তো তাকেই সামরিক অভ্যর্থনা জানানোর
প্রস্তুতি চলছিল।
রেমব্রান্ট প্লেইন |
"নাইট ওয়াচ"
প্রথমে "গ্রেট
হল" যা বর্তমানে "দোয়েলেন হোটেল" -এ
টাঙ্গানো হয়। এরপর ১৭১৫ সালে একে নিয়ে আসা হয় আমস্টারডামের "টাউন
হলে"। সেখানে জায়গার অভাবে এই ছবির তিন দিক কেটে
ফেলা হয়। এতে দুজন ছবির থেকে বাদ পড়ে যান। রাইখস মিউজিয়ামে এই ছবিটির পাশেই একট
ছোট কপি আছে যা কাটার আগে আঁকা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এতে দুজন ছাড়া উপরেও বেশ
কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে, ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে এই অংশগুলিই কাটা
হয়েছিল। কাটার পর দেখা যায় ক্যাপ্টেন ফ্রান্স ছবির কেন্দ্রে চলে এসেছেন, যা
ক্লাসিকাল শিল্পের ধারা মেনে চলে। কাটার ফলে এই একটাই উপকার হয়েছিল বলে অনেকে মনে
করেন। ১৮৮৫ সালে পিয়ের ক্যুইপার রাইখস মিউজিয়ামের বাড়িটি তৈরি সম্পূর্ণ করার পরে
সেখানেই এর পাকাপাকি স্থান হয়। এরপরেও দু'বার সাময়িকভাবে ছবির স্থান বদল হয়। প্রথমে ১৯৩৯
সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এক কৃত্রিম গুহায় প্রায় ৮০০ ছবি লুকিয়ে রাখা
হয়। যুদ্ধের শেষ হলে এদের আবার বের করা হয়। এই ছবিগুলিকে ডাচরা তাদের বহুমূল্যবান
সম্পদ বলে মনে করত। এই গুহার ইতিহাস পড়লে বোঝা যায় ডাচরা শিল্পের প্রতি জাতি
হিসাবে কতটা নিবেদিত প্রাণ। আজকের দিনে এই গুহায় ট্যুর করা যায়। অদ্ভুত সব গল্প
একে ঘিরে। এরপর ২০০৩ সালে রাইখস মিউজিয়ামের মেরামতির সময় একে আবার সরানো হয় যা কাজ
শেষ হলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ডাচরা
জীবন দিয়ে এই ছবিকে ভালোবাসে। তাই ডাচদের জানতে হলে এই ছবিকে ও তার ইতিহাস জানা
জরুরি।
ঋজু
ঘোষ, মার্চ - এপ্রিল ২০২০
Comments
Post a Comment