গীতাঞ্জলির নোবেল প্রাপ্তি, রবীন্দ্রনাথ ও কাঁকড়া বাঙালি
।। ১ ।।
বাঙালি কাঁকড়ার জাত। পৃথিবীর যেকোন প্রান্তেই সে থাকুক না কেন, বাঙালিরা প্রথম যে কাজটা করে সেটা হলো একটি ক্লাব তৈরি করা। তারপর সেই ক্লাবে নিয়মিত খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটে গেলে একটি পূজার আয়োজন করা হয়। সেই পূজা কমিটিতে কে কী হবেন কী হবেন না সেই নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই একটা দ্বন্দ্বের তৈরি হয় এবং তারপর সেই ক্লাব দুভাগ থেকে চার ভাগ থেকে আট ভাগ হতে হতে বহু ক্লাবের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে যদি অন্যান্য ভারতীয় ভাষাভাষীদের আপনার লক্ষ্য করেন তবে দেখবেন, তাদের মধ্যে কী সাংঘাতিক ঐক্য। আমেরিকায় তামিলদের একটি শক্তিশালী সংগঠন আছে। এমনকি তামিলরা মিলিতভাবে এমআইটি ইনস্টিটিউটে (MIT) ডোনেশন দেয়। তারফলে একটি তামিল চেয়ার ও কিছু তামিল ছাত্রছাত্রীরা সেখানে পড়াশোনার সুযোগ পায়। পাঞ্জাবিরাও একইভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে তাদের পাঞ্জাব প্রদেশের বাইরে। সে ভারতেই হোক বা বিদেশে যেকোন জায়গায়, পাঞ্জাবিরা অন্য আরেকজন সদ্য আগত পাঞ্জাবিকে মুক্তহস্তে সাহায্য করে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে। তবে তা কখনই এককালীন নয়, নিঃশর্তভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিও সেই টাকা বিনা দ্বিধায় ফিরিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠিত হবার পরে। এর পরে সে যখন নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, একইভাবে আরো একজন বা কয়েকজনকে সাহায্য করে যাতে তারা তারই মতো সফল হয়ে উঠতে পারে। এধরনের পারস্পরিক সাহায্যের প্রবণতা আপনারা ভারতীয় উপজাতি যেমন ধরুন, পাঞ্জাবি, তামিল গুজরাটি ইত্যাদির মধ্যে সাংঘাতিক ভাবে প্রখর। যা বাঙ্গালীদের মধ্যে একেবারেই দেখা যায়না। বাঙালি একটি ঈর্ষাপরায়ণ জাতি। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য বহুদূরে যুগ ধরে।
১৯১২ সালে প্রথম ইংরাজীতে ছাপা গীতাঞ্জলি (ছবিঃ ব্রিটিশ লাইব্রেরী)
প্রসঙ্গতঃ রবীন্দ্রনাথের নিজের করা গীতাঞ্জলীর ইংরাজি অনুবাদ ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পায়। প্রথম ভারতীয় হিসাবে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি প্রথম। অমর্ত্য সেনের আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙালি।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ইংরেজি অনুবাদের ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে, বেশি দূরে নয় ১৯১২ সালের ২৯ শে মার্চ। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রসিদ্ধ ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র একসঙ্গে কলকাতা থেকে লণ্ডন যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাত্রার পূর্বমুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার জন্য দ্বিজেনবাবু একাই যান ও ডাক্তাররা রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে উপদেশ দেন। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারি পদ্মাতীর শিলাইদহে পৌঁছে যান। সেখানে গিয়ে তিনি গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, খেয়া প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ থেকে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক কবিতাগুলিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে থাকেন সময় কাটানোর জন্য। কর্মবীর রবীন্দ্রনাথ চুপচাপ বসে থাকতে পারতেন না। তৎকালীন বাঙালি জমিদার মানেই একটা বিলাসবহুল জীবন - আমাদের চোখে তাই ভেসে ওঠে। এইখানে রবীন্দ্রনাথ একেবারেই বেমানান ছিলেন ব্যাভিচারী জমিদার হিসেবে। আজকে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির পেছনে তাঁর আর্থিক আনুকূল্যকে দায়ী করেন। কিন্তু এটাও ভাবার বিষয় যে, রবীন্দ্রনাথের মতন বাঙালি জমিদার তখন অনেকেই ছিল। কিন্তু কতজন রবীন্দ্রনাথের মত দুটি লাইন লিখে যেতে পেরেছেন যা এখনও মানুষ পড়ছে?
১৯১২ সালের হাজার ১৯ শে মার্চ রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার খবর তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চিঠি থেকে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের একটি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লিখেছেন, “আজ সকাল বেলায় বাবার সমস্ত ঠিক এমন কি কাপড় ছেড়ে প্রস্তুত হয়েছেন -- এমন সময় এমনি একটি nervous attack হল যে আর যেতে পারলেন না।” পরবর্তীকালে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনী দ্বিতীয় খন্ডের একটি জায়গায় লিখেছেন -- “ ইতিমধ্যে ‘কবির শরীরটা কিছু বিগড়েছে’। ‘অর্শের রক্তপাত কিছুদিন থেকে বেড়েছে।’ এই রোগে বহুকাল হইতে তিনি ভুগিতেছেন। বিলাত আসার অন্যতম কারণ ছিল এই অর্শ চিকিৎসা।”
To be continued....
Comments
Post a Comment