আন্তর্জাতিক সত্যজিৎ রায় ও ১০০তম জন্মদিন
গ্লোবালাইজেশনের বহু আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আন্তর্জাতিক। তাঁর এই খ্যাতি রাতারাতি আসেনি।বরং এর পেছনে রক্ত জল করা অধ্যায় রয়ে গেছে। সত্যজিৎ মূলত যে কারণে সারা পৃথিবীতে পরিচিত তা হল তাঁর সিনেমা। যার মধ্যে বেশিরভাগই বাংলা সিনেমা যা পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই বলতে বা বুঝতে পারেনা। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা তৈরি করা শুরুর সেই সময়টার দিকে তাকালেই আমরা কিছুটা ধারনা পাব। তাঁর প্রথম সিনেমা পথের পাঁচালী ১৯৫৫ সালে রিলিজ করে। এরপর প্রায় প্রতিবছরই একটি করে সিনেমা রিলিজ করতে থাকে -- অপরাজিত (১৯৫৬), পরশপাথর (১৯৫৭), জলসাঘর(১৯৫৮), অপুর সংসার (১৯৫৯), দেবী (১৯৬০) ইত্যাদি।
এইভাবে চলছিল ভালোই কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ১৯৬২ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমা তৈরি হবার পরেই। ১৯৬৩ সালের শুরুর দিকের ঘটনা -- তখন সত্যজিৎ রায় ক্রমাগতই সম্মুখীন হচ্ছেন নানারকম বাধার। কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমার জন্য রঙিন ফিল্ম সেসময় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার ফিল্মের আমদানি কমিয়ে এনেছে। এর কারণ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। তারপরেই একটি চীনের সঙ্গে ছোটখাটো যুদ্ধের কারণে গোটা বাংলার সিনেমার জগতে নেমে এসেছে এক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। বাংলা সিনেমার সব থেকে বড় বাজারে যা বর্তমানে বাংলাদেশে তা তখনও পূর্ব-পাকিস্তান। যুদ্ধের পর পরই পাকিস্তানের সরকার ভারত থেকে সিনেমার আমদানীতে নিষেধাজ্ঞা এনেছে -- এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হিন্দি এবং বাংলা দুটি সিনেমাই। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখতেন বহু পূর্ব পাকিস্তানের দর্শক। বন্ধ হয়ে গেছে সমস্ত ভারতীয় সিনেমা দেখান।
এই চরম দুঃসময়ে সত্যজিৎ হয়ে উঠলেন আন্তর্জাতিক। যা মূলত শুরু হয়েছিল তাঁর মহানগর (১৯৬৩) সিনেমাটি দিয়ে। মহানগর সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সিনেমা যা তৎকালীন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে রিলিজ করা হয়। ১৯৬৩ সালেই সত্যজিৎ মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথমবারের জন্য বিচারক হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ফেলিনি প্রধান পুরস্কারটি পান যা আজও বিতর্কিত। এরপরে বার্লিন সহ নানা আন্তর্জাতিক সিনেমা জগৎ থেকে তাঁর জন্য একের পর এক আমন্ত্রণ আসা শুরু হয়। সত্যজিৎ হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক সিনেমা মহলে এক পরিচিত মুখ। শোনা যায় তিনি এত আমন্ত্রণ পেতেন যে বাধ্য হয়ে কিছু নাকচ করে দিতে হত সময়ের অভাবে। এরপর ধীরে ধীরে সত্যজিৎ পরিচিত হতে থাকেন বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভাল ছাড়াও তৎকালীন আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবি মহলে। ১৯৬৫ সালে মেক্সিকো ফিল্ম ফেস্টিভালে বিচারক হিসাবে উপস্থিত থাকার পর ফেরার পথে দেখা করেন E.M. Forster এর সাথে কেমব্রিজে। তারপর চলে যান অস্ট্রেলিয়া, যেখানে সত্যজিতের সিনেমার কদর আগের থেকেই ছিল।
সত্যজিতের আন্তর্জাতিক পরিধি ও পরিচিতি কিন্তু বাংলা সিনেমা জগতের অর্থনৈতিক অবনতির উন্নতি করতে পারেনি। অর্থনৈতিক অবনতি এসেছে মূলত ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে। যখন বাংলা ভেঙ্গে দু'ভাগ করা হল, তখন ভারতীয় বাংলা সিনেমার জগত ছোট হয়ে গেল। আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা কারা দেখেন? যারা সেই ভাষায় কথা বলেন। পূর্ববঙ্গের অজস্র বাঙালি যারা সত্যজিতের সিনেমা দেখার দর্শক হতে পারতেন তারা বঞ্চিত হলেন রাজনৈতিক কারণে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যেখানে বাঙ্গালিরা বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে নিজের দেশে, নিজের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য একে একে শহীদ হচ্ছেন কিশোর ও দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ -- এরই মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করে বাংলা সিনেমা দেখার অনুমতি পাকিস্তান সরকার থেকে পাওয়া এক ধরনের রূপকথারই শামিল। তাই সত্যজিৎ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কাছে অধরাই থেকে গেলেন।
যদিও চেষ্টা চলছে ভারতের অন্যান্য শহরগুলিতে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য সত্যজিতের সিনেমা দেখানোর। দক্ষিণের মাদ্রাজ শহরে সপ্তাহান্তে দেখানো হতো এইসব সিনেমা। অ-বাঙ্গালীদের জন্য সেই সময় কেবলমাত্র কাপুরুষ-মহাপুরুষ সিনেমাটি হিন্দি ডাব করা হয়েছিল। তিনকন্যা ছাড়া আর কোন সিনেমার ইংরেজি সাবটাইটেল ছিলনা তখন ভারতে। এর পেছনে প্রচার ও প্রসারকেও দায়ী করা যায়। তৎকালীন হিন্দি সিনেমার জন্যে যে ধরনের প্রমোশন হত তার ছিটেফোটা বাংলা সিনেমায় ছিল না। এছাড়াও আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি জায়গায় অভিবাসী ভারতীয়রা হিন্দি সিনেমা নিয়ে বেশি উৎসাহিত ছিলেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও বাঙ্গালীদের মধ্যে হিন্দি সিনেমা দেখার প্রবণতা তৈরি হয়। বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলিতে হিন্দি সিনেমা নিয়ে বহু কিছু লেখা হতে থাকে। তৎকালীন বাঙালি অভিনেতা যাঁরা ভালো হিন্দি বলতে পারতেন তাঁরা সকলেই বম্বে চলে যেতে থাকেন। অপুর সংসার ও দেবী সিনেমার সাফল্যের পরে শর্মিলা ঠাকুর বম্বে চলে যান। কলকাতা ও তার আশপাশের বিভিন্ন সিনেমা হলগুলোতে বাংলা সিনেমা বাদ দিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখানো হতে থাকে। একজন সিনেমার প্রযোজক সেইসব সিনেমাতেই টাকা ঢালবেন যার দর্শক সংখ্যা বেশি। এর ফলে বাংলা সিনেমা প্রযোজনার ক্ষেত্রে দেখা দিল আকাল।
সত্যজিৎ কম বাজেটের সিনেমা নিয়ে ভাবতেন। খুব কম টাকা বানিয়েছিলেন অশনি সংকেত, পথের পাঁচালী ইত্যাদি। ১৯৬৩ সালে উপেন্দ্রকিশোরের শতবর্ষে পুত্র সন্দীপের আবেদনে সত্যজিৎ ফ্যান্টাসি সিনেমা সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। সন্দীপ রায় মনে করতেন, তাঁর বাবার বানানো সিনেমাগুলি বড়ই দুঃখের। এই পরিস্থিতিতে সত্যজিৎ গুপিগাইন-বাঘাবাইন নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। সিনেমাটি রঙিন করলে খরচা বেড়ে যাবে বলে সাদাকালো করবেন বলে ঠিক করেন।
সত্যজিৎ তাঁর সিনেমার নতুন নায়িকা মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেন, সাথে পেয়ে যান R. D. Bansal কে প্রযোজক হিসেবে। পশ্চিমবাংলার প্রযোজকরা মূলত ছিলেন ব্যবসায়ীরা । যারা কালোটাকা সাদা করার জন্য সিনেমা প্রযোজনা করতেন। বনশল এদের মধ্যে একটু আলাদা ছিলেন। সিনেমায় প্রযোজনা করাটাই ছিল বনশলের মূল ব্যবসা। সত্যজিৎ ভেবেছিলেন বনশল গুপিগাইন-বাঘাবাইন সিনেমার জন্যেও টাকা ঢালবেন। এই ভেবেই কাজ শুরু করেছিলেন। এতটাই ভাল ছিল এদের দুজনের সম্পর্ক। কিন্তু বাংলা সিনেমার উপার্জন তেমন ছিল না বলে বনশল ঠিক করেন তিনি এরপর থেকে হিন্দি সিনেমাতেই পয়সা ঢালবেন।
এতগুলি ঘটনা বর্ণনার পেছনে একটিই কারণ -- ১৯৬০ সালে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধীরগতি থাকা সত্বেও সত্যজিৎকে কেবলমাত্র পশ্চিমবাংলা বা ভারতবর্ষের সীমানায় আটকে রাখা যায়নি। তিনি সব দিক থেকে হয়ে উঠেছেন একজন আদর্শ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। এখানেই সত্যজিৎ একশোয় একশো ।।
শুভ ১০০ সত্যজিৎ রায়চৌধুরী।
-- ঋজু, ১লা মে ২০২১
Comments
Post a Comment