ঈদ মোবারক ও বিরিয়ানি ডে

 বিরিয়ানি ডে

----------

ঈদ মানেই বিরিয়ানি খাওয়া এর ওর বাড়িতে গিয়ে। এত গেল ছাত্র জীবনের কথা। এরপরে এলো চাকরি জীবন। শুরুতে কয়েক বছর চরকি কাটার মতন ভারতবর্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়াতাম। মাসে দু -তিনটে করে ফোন নাম্বার বদল করতাম, তার কারণ তখন রোমিং কস্টলি ছিল। আর ফোনের সিম পেতে তেমন ঝামেলা হতো না। একদম রেডিমেড সিম পাওয়া যেত যা ফোনে ঢোকালে সাথে সাথে চালু হয়ে যেত। যাই হোক এইরকম যাযাবর জীবনের মাঝে একবছর আলীগড়ে থাকার সুযোগ হয়েছিল। 


সেই সময় আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে লাইব্রেরী অটোমেশনের প্রজেক্ট চলছিল। আমি হলাম গিয়ে আদার ব্যাপারী, আমার কাজ ছিল রোজ কম্পিউটার সেকশনে গিয়ে আমাদের সফটওয়্যারটা ঠিকমত কাজ করছে কিনা তা দেখা এবং কোনো অদল বদল হলে তা করে দেওয়া বা তা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এইসব করতে গিয়ে নানা রকম লোকের সঙ্গে পরিচয় হত। 


আমার বস আবার নিরামিষাশী পাঞ্জাবি ছিলেন, সঙ্গে এক বাঙালি ছিল সে আবার শনিবার নিরামিষ খাওয়া পাবলিক। তখন সে চুটিয়ে প্রেম করছে, মেয়েটির জেএনইউতে পিএইচডি-রতা। ওর বিকম পাস ও লাইব্রেরী সাইন্স ডিগ্রী নিয়ে কনফিডেন্স একেবারে তলানিতে। অর্থাৎ মেয়েটি ওকে বিয়ে নাও করতে পারে এইরকম একটা ধারনা শুতে যাওয়ার আগে, মাঝখানে ও ঘুম থেকে উঠে ও করত। তাই শনিবার দিন আমিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হয়েছি। ওর ধারণা ছিল যদি সমস্ত নিয়মকানুন ঠিকঠাক ভাবে পালন করতে পারে তবে হয়তো মেয়েটি ওকে বিয়ে করলেও করতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা আমিষ-নিরামিষ এর মাঝখানে আমি ওর পাশে বসেই বাটার চিকেন দিয়ে কুলচা মেরে দিতাম শনিবার দিন। ও করুণ চোখে তাকাতো, তারপর উদাস মুখে রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষদের অকারণ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করত। 


সেইবার ঈদ শনিবার। আমার যথারীতি প্রচুর অলিখিত নেমন্তন্ন হয়ে গেছে। অর্থাৎ সকালবেলা ফোন করে দিলেই দুপুরের থালা রেডি থাকবে। এইরকম আপ্যায়িত হবার কারণ, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে তখন সদ্য কম্পিউটার এসেছে আর কোন বড়োসড়ো উচ্চপদস্থ অধ্যাপক ঘোষণা করেছেন যারা কম্পিউটার শিখে ফেলতে পারবে তাদের চাকরির উন্নতির সম্ভাবনা প্রচুর। সেই সময় আমার অনেক অসমবয়সী ছাত্র ছিল যাদের আমি সলিটায়ার খেলা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড ফাইলে টাইপ ও প্রিন্ট করা অব্দি শেখাতাম। এদের কেউ কেউ দু'বছর পরেই হয়তো রিটায়ার করবেন। কিন্তু যদি শেষ একটা প্রমোশন বাগানো যায় তাহলে পেনশনটা একটু বেশি পাওয়া যাবে। তাই কম্পিউটারের শেখাটা জরুরি, আর আমার মতন প্রাইভেট টিউটর সহজে পাওয়া যেত না। রেষারেষি চরম ছিল তখন। কেউ কিছু জানলে অন্যকে শেখাত না। একই টেবিলের দুপাশে বসা দুজনকে আলাদা আলাদা করে একই জিনিস শেখাতে হত। যা সহজেই একজন আরেকজনকে শিখিয়ে দিতে পারে। সুতরাং আমার মার্কেট ভ্যালু তুঙ্গে ছিল।


এইসব জামাই আদরকে উপেক্ষা করতে হল অবশেষে, কারণ আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি তৎকালীন লাইব্রেরী সাইন্স ডিপার্টমেন্টের হেড আমাদের বসকে নেমন্তন্ন করেছেন যেখানে আমাদেরও যেতে হবে। 


ভদ্রলোক খানদানি বড়লোক।  বসবাস করেন পেল্লায় রাজপ্রাসাদের মতন বাড়িতে। যার অন্দরমহল ও বাহিরমহল আলাদা। বাড়ির বাসিন্দারা অন্দরমহলের দরজা দিয়ে ঢোকে, বাহিরের অতিথিরা বাহির মহলের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে কেবলমাত্র সেই জায়গাতেই ঘোরাফেরা করতে পারেন। অন্দরমহল যে আছে তা বোঝা যায় না। 


ভদ্রলোকের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল তাঁর অতিথিপরায়ণতা। কারোর অতিথি পরায়ণতার জন্য যদি আমি বিন্দুমাত্র বিড়ম্বিত হয়ে থাকি তবে তা প্রথম অনুভব করেছিলাম আলীগড়ে ওই বাড়িতে। 


যেহেতু আমাদের তিনি নেমন্তন্ন করেছেন তাই আমরা নিয়ম অনুযায়ী যখন বাহিরমহলের দরজা দিয়ে প্রবেশ করছিলাম সেই সময় ছোট্ট একটি ছেলে সাদা রঙের পাঞ্জাবি পাজামা পরা অবস্থায় ছুটে এসে আমাদেরকে অন্য একটি দরজা দিয়ে ঢোকালো অন্দরমহলে। আমরা একটু ইতস্তত বোধ করছিলাম। এই সময়ে তিনি বেরিয়ে এলেন এবং আমাদের বললেন ঈদের দিন আমরা চৌধুরীকে (আমার বস) নেমন্তন্ন করেছি। বাহিরমহল অতিথিদের জন্য আর ভেতর মহল আত্মীয়দের। আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। এতটাও আন্তরিক হওয়া সম্ভব একেবারে অচেনা কিছু লোকের সামনে? আমি তো অন্তত কোনদিনও ওনার সঙ্গে কথাই বলিনি। তার কারণ আমার কাজ লাইব্রেরীর কম্পিউটার সেকশনের বাইরে ছিল না।


শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হল। এরপর আমরা পৌঁছে যাই খাওয়ার টেবিলে। এই টেবিলে মোটামুটি কুড়িজন বসে একসঙ্গে খেতে পারে। সমস্ত টেবিল জুড়েই নানারকম পোর্সেলিনের পাত্রে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা ছিল। গৃহকর্তা আমাদের আলাদা আলাদা করে রাখা পাত্রের মাহাত্ম্য বোঝাতে শুরু করলেন। এরমধ্যে নিরামিষ ও গোস্ত বিরিয়ানি ভালোভাবে রাখা ছিল একে অপরের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। এর কারণ আমার বস যে নিরামিষভোজী তা অনেকেই জানতেন আর যদি মাংসের ব্যাপারে আমরা খুঁতখুঁতে থাকি তাহলে ব্যবস্থা তৈরি। আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে পড়লাম এবং বসেই লক্ষ্য করলাম আমি দুই নিরামিষ পাবলিকের ঠিক মাঝখানে বসে আছি। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল জীবনে একটা বড় ভুল করে ফেললাম। যে ধরনের গন্ধ আমার নাকে মাঝেমাঝেই কালবৈশাখী ঝড়ের মত হানা দিচ্ছিল, সে গন্ধ ভেজ বিরিয়ানি থেকে বেরোবে না। তার আগে আসার পথে গাড়িতে আমি বসকে ভেজ বিরিয়ানি নিয়ে লেকচার দিয়েছিলাম। তার মূল কথা ছিল ভেজ বিরিয়ানি বলে কিছু হয় না ওটা আসলে প্রলাপ। একধরনের ঝরঝরে খিচুড়ি।


যাইহোক টেবিলে বসে মতলব করছি যে কিভাবে ভেজ বিরিয়ানি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। এইরকম গন্ধওয়ালা বিরিয়ানি না খেতে পারলে জীবন বৃথা। নানারকম এদিক-ওদিক উল্টোপাল্টা খাবার পরিবেশিত হওয়ার পরে যখন বিরিয়ানি পাত্র আমাদের দিকে এগিয়ে দেওয়া হল তখন আমি ইতস্তত করছিলাম। আমার বস কিছুটা হলেও আমার উদ্দেশ্য অনুভব করতে পেরেছিলেন। তিনি উদ্যোগী হয়ে বলে উঠলেন, এ তো পাক্কা ননভেজ হ্যায়। সেই মুহূর্তে আমার বসকে দুগালে দুটো চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল।।

Comments

Popular posts from this blog

ভিনসেন্ট ভ্যানগখ এর সাথে

ডাচ গোল্ডেন এজ, রেমব্রান্ট ও নাইট ওয়াচ