বৈদিক সাহিত্য, শিক্ষা ও হিন্দু ধর্ম
সাহিত্য ধর্মের মূল কথা ধরে রাখে। আজকের টিকে থাকা গুটিকয় ধর্মগুলির প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ধর্মীয় পুস্তক আছে। যার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে তার শিক্ষা ও দর্শনের প্রচার ও প্রসার হচ্ছে। যে সব ধর্ম হারিয়ে গেছে, লক্ষ করলে দেখা যাবে সেইসব ধর্মে কোন লিখিত গ্রন্থ ছিল না। লিপি আবিষ্কারের আগে এই প্রথাগত পুস্তক মানুষ শুনে তার স্মৃতিতে ধরে রাখত। সেই কারনেই বেদকে “শ্রুতি” বলা হয়। যেহেতু বেদ লিখিত অবস্থায় দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিল তাই এর শ্লোকগুলি জটিল সমাস-জর্জরিত ছিল না, যাতে মনে রাখার সুবিধা হয়। নানা ধর্ম নানা সময়ে অন্য ধর্মের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, গ্রামকে গ্রাম মানুষ খুন করা হয়েছে ধর্মবিনাশের জন্যে, তবুও কিছু ধর্ম আজও টিকে আছে তাঁর কারণ পালিয়ে বাঁচা মানুষের মনে ধর্মীয় সাহিত্য টিকে থাকত। তাই ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিলেও মানুষের মস্তিষ্ক হরণ করা যায় নি।
হিন্দুধর্ম একটি ধর্ম নয়, একে অনেকগুলি ধর্মের সহাবস্থান বলে মনে করা হয়। যেহেতু হিন্দুধর্ম প্রাচীন তাই এর সাহিত্যও সুবিশাল। হাজার বছর ধরে নানা ব্যাখ্যা নানা শিক্ষক বা গুরুরা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বেদ দিয়ে এর শুরু হলেও - উপনিষদ, স্মৃতি, সূত্র, ইতিহাস, দর্শন, পুরাণ ইত্যাদির জটিলতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আজ একজন হিন্দুর কাছেও এই ব্যাপারগুলি অতটা স্পষ্ট নয়। তাই নানা সময়ে এর নানা-প্রকার অপব্যাখ্যা করা হয়। আসলে সময়ের সাথে সাথে মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধি হয়েছে। তাই আজকে আর বৈদিকশিক্ষা একান্ত প্রয়োজনীয় নয়। একাডেমিক কারনে আজ মানুষ বৈদিক সাহিত্যের চর্চা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের রহস্য ও মানুষের অসহায়তার থেকেই বৈদিক সাহিত্যের সৃষ্টি। তারপর ধীরে ধীরে মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। যার ফলে মানুষ বুঝতে শিখেছে এসবের কারন। আজকে তাই বিজ্ঞানচর্চার বেশি প্রয়োজন। এর পাশাপাশি যুক্তির সাহায্যে বৈদিক সাহিত্যের মুল্যায়ন হচ্ছে।
হিন্দু ধর্ম কি আজ অস্তিত্বের সংকটে? নাকি হিন্দু ধর্মকে আরো প্রচার ও প্রসার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে?
মানুষ যখন প্রকৃতির কাছে অসহায় হয়ে পড়ে তখনই সে ধর্মের আশ্রয় নেয়। বন্যা, মহামারী, আগুন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে বহুযুগ ধরে মানুষ বারবার পরাজিত হতে হতে এইসব অজানা শক্তিগুলিকে ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তাই যে কোন প্রাচীন ধর্মেই দেখা যায় অগ্নি, জল, বায়ু ইত্যাদির উপাসনা করা হচ্ছে।
অন্য সব প্রাচীন ধর্মের মত হিন্দুধর্মও অগ্নি, জল, বায়ু ইত্যাদির উপাসনার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। যতদিন পর্যন্ত হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব বাকি পৃথিবীর কাছে অজানা ছিল, ততদিন পর্যন্ত এই ধর্মের কোন নাম ছিল না। পরবর্তীকালে বিভিন্ন আক্রমণকারী দ্বারা দীর্ঘ উর্বর সিন্ধু উপত্যকা আক্রান্ত হলে তারা আবিষ্কার করে এইখানকার বসবাসকারী মানুষের ধর্মাচরণ। নাম দেয় হিন্দুধর্ম। আজকের টিকে থাকা মূল ধর্মগুলি থেকে হিন্দুধর্ম তাই একটু হলেও আলাদা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা মুসলিম ধর্মগুলি প্রত্যেকটি কোন একজন মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মের এইরকম কোন একজনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই ধর্ম কোন একজনের জীবনী বা বাণী অনুসরণ করে তৈরি করা হয় নি।
যখনই কোন ধর্ম অন্য ধর্মের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, তখনই সেখানে বল প্রয়োগের প্রশ্ন এসেছে অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে। শুরুতে হিন্দুধর্মে এই ধরনের কোন আক্রমণ ঘটেনি তাই এর শুরুটা অনেকটাই যাগযজ্ঞ ইত্যাদি দ্বারা সমৃদ্ধ হলেও মানুষ তার পাশাপাশি আধ্যাত্বিক বিকাশের জন্য অভ্যাস চালিয়ে গেছে। এই আধ্যাত্বিক বিকাশের অন্যতম কারণ হলো যে ধরণের যাগ-যজ্ঞ বা পূজা-অর্চনা মহাভারতের যুগে প্রচলিত ছিল তা অনেকটাই খরচসাপেক্ষ ব্যাপার। তাই তা সাধারণত রাজা বা বণিক সম্প্রদায় দ্বারা পরিচালিত হতো। তখন মানুষের ঘরে ঘরে পূজা করার চর্চা ছিল না। মন্দির ব্যাপারটি তখনও সেইভাবে প্রকট হয়ে ওঠে নি। কিন্তু মানুষ শিক্ষাদীক্ষার জন্য গুরুগৃহে গমন করত। যেহেতু লিপির প্রচার ও প্রসার ছিল না, তাই শ্লোকগুলি গুরুর মুখে শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখাটা মূল উদ্দেশ্য ছিল সেই শিক্ষার। সেই জন্যই বেদের অপর নাম “শ্রুতি”।
বেদঃ শিক্ষার উপকরণ হিসেবে তখন বেদগুলিকেই গণ্য করা হত। ঋক্, সাম, যজুর এবং অথর্ব এই চারটি বেদকেই শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানের উপকরণ হিসেবে গণ্য করা হতো। তখনকার গুরুদের কেবল এইসব বেদের স্তোত্র মুখস্ত করানোই কাজ ছিল না, এর সাথে মুখে মুখে তাঁরা সেগুলির ব্যাখ্যাও করতেন। সটীক বেদের শিক্ষা হত গুরুগৃহে। বেদের শ্লোকগুলি মোটামুটি তিনটি ভাগে বিভক্ত থাকতো -- মন্ত্র, ব্রাহ্মণ এবং উপনিষদ। বক্তব্য হচ্ছে, এর কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? একজন গুরু তিনটে ভাগকেই সমান গুরুত্ব সহকারে শিষ্যদের কাছে ব্যাখ্যা করতেন। বেদের প্রতিটি অক্ষরকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হত। তবুও এরমধ্যে উপনিষদ সবচেয়ে বেশি দার্শনিক তথ্য বহন করে। মনে করা হত মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ (যা মন্ত্রের ব্যাখ্যা) -- এই দুটির মিলনেই উপনিষদের বৃষ্টি। উপনিষদের মধ্যে নিছক পূজা-অর্চনার পদ্ধতি আলোচনা না করে তার মধ্যে গভীর দর্শনকে উপস্থাপিত করা হয়েছিল।
উপনিষদঃ এই চারটি বেদে অনেকগুলি করে উপনিষদ ছিল। মূল উপনিষদের সংখ্যা ১২। এগুলি হল ঈষ, কেনো, কথা, প্রশ্ন, মুন্ডক, ঐতরীয়, তৈত্তরীয়, ছান্দগ্য, বৃহদাকরণ্য, ইত্যাদি। এই বারোটি উপনিষদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ -- কারণ এরা সরাসরি চারটি মূল বেদের অংশ। বৈদিক শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যা হিসাবে এইগুলিকেই গণ্য করা হয়। শ্রুতির পরেই আসে “স্মৃতি”।
স্মৃতিঃ স্মৃতি হল মানুষের দ্বারা তৈরি করা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের নিয়মনীতি। মনে করা যেতে পারে হিন্দু সমাজের আইনগ্রন্থ। এই আইনগুলি যুগের সাথে সাথে বদলেছে। প্রত্যেক গুরু নিজেদের অধ্যয়ন ও জ্ঞান অনুযায়ী এইসব আইনে সম্পাদনা করেছেন। হিন্দুধর্মে চিরকালই নতুন নিয়মনীতির আগমনকে আপ্যায়িত করা হয়েছে। তাই যুগের সাথে সাথে ব্যাপক বদল হয়েছে। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রণেতাদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর ইত্যাদি। ধর্ম অর্থাৎ একজন নাগরিকের সামাজিক কর্তব্যগুলি এই স্মৃতি গ্রন্থগুলিতে লেখা থাকত। এগুলিকে ধর্মশাস্ত্র বলে। এর ভেতরে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে প্রতিটি ব্যাপারে দিকনির্দেশ করা থাকত। সমাজের বিভিন্নবর্গের মানুষরা কে কী করবেন, তার আলাদা আলাদা বর্ণনা থাকতো। এমনকি একজন অপরাধীর কী শাস্তি হবে তাও লেখা থাকতো। মনুষ্য সমাজে এই স্মৃতিগ্রন্থগুলিকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হত রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে। সাথে দেশকালের প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু আইনকানুন বাদ দেওয়া হত, আবার কিছু নতুন আইন কানুন যোগ করা হত। সেই অর্থে দেখতে গেলে, স্মৃতিশাস্ত্রগুলি ক্রমাগত অদল-বদল হত যা কখনোই বেদের ক্ষেত্রে হয় নি। তাই স্মৃতি শাস্ত্রকে শ্রুতির নির্যাস গ্রন্থ হিসেবে ধরা যেতে পারে। যদি স্মৃতিকে আমরা শরীর বলে ভাবি তবে শ্রুতি (বেদ) তার আত্মা।
ইতিহাসঃ স্মৃতির পরেই আসে ইতিহাস, পুরাণ এবং দর্শন। অনেক সময় এগুলোকে বৃহত্তর অর্থে স্মৃতির অংশ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। যদি আমরা শ্রুতিকে আত্মা হিসেবে ধরি এবং হিন্দুধর্ম অনুযায়ী আত্মা তার শরীর বদল করতে পারে, তবে এই শ্রুতি আত্মা হিসেবে কখনও দর্শন, কখনও ইতিহাস, কখনও পুরাণ হিসাবে বৈদিক সাহিত্যে দেখা দিয়েছে।
রামায়ণ ও মহাভারত এই দুটি মহাকাব্যকে আমরা ইতিহাস বলে থাকি। বিভিন্ন গল্প, ঘটনা, বেদের শিক্ষা, স্মৃতির আইন ইত্যাদি সব কিছুকেই এই মহাকাব্যগুলির মধ্যে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। “হিন্দুধর্ম“ এখানে মনে রাখতে হবে “ধর্ম” বলতে সমাজে একজন মানুষের কী কর্তব্য তাই বলা হয়েছে। একজন শিশু যেমন খুব মন দিয়ে গল্প শোনে, তেমনই একজন পরিণত মানুষও গল্প শুনতে ভালোবাসে। রামায়ণ মহাভারতের মাধ্যমে এই ধর্ম অর্থাৎ মানুষের কর্তব্যকে প্রান্তিক জনগণের কাছে পৌঁছানোর একটা প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। এবং তাতে অনেকটাই সফলতা এসেছিল বলে মনে করা যেতে পারে।
যদি ধরা হয়ে থাকে যে বেদ কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষিতদের জন্য, তাহলে রামায়ণ ও মহাভারত হল প্রান্তিক মানুষের জন্য। যেমন রামায়ণে রামকে আদর্শ রাজা হিসেবে দেখান হয়েছে। সীতাকে আদর্শ স্ত্রী ও লক্ষণ এবং হনুমান হলেন আনুগত্যের প্রতীক।
মহাভারতকে তৎকালীন সময়ের একটি বিশ্বকোষ হিসাবে দেখা যেতে পারে। অজস্র ছোটবড় গল্প, অসংখ্য অধ্যায়, কথোপকথন, নীতিশিক্ষা ইত্যাদি দিয়ে সমৃদ্ধ এই বিশাল মহাকাব্য। এখানে মানুষরূপী কৃষ্ণ, যাকে একজন শিক্ষক এবং নেতা হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। আছে দলনেতা যুধিষ্ঠির। আছেন ভীষ্ম - যার দীর্ঘ শিক্ষাদান শান্তিপর্বে লিপিবদ্ধ করা আছে।
গীতাঃ এরই মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল ভগবদ্গীতা। যখন অর্জুন তার চারপাশে নিজের ভাই ও আত্মীয়দের দেখতে পাচ্ছেন এবং প্রধানযোদ্ধা হিসেবে বুঝতে পারছেন যে সকলের মৃত্যু হয়ত তারই হাতে, সাংঘাতিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। একজন যোদ্ধার কর্তব্য কী -- যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। অনেক সময় গীতাকে উপনিষদগুলির সারসংক্ষেপ হিসাবে ধরা হয়। যদি উপনিষদগুলি ফুল হিসেবে ধরা হয় তবে গীতা তার মধু। মানুষের চিরকালের প্রশ্নগুলি গীতায় ফুটে উঠেছে। একজন সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এবং তার কর্তব্যের পরিণতি নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। মেটাফিজিকাল দর্শনের আদর্শ গ্রন্থ “গীতা”।
ব্রহ্মসূত্রঃ গীতার পরেই আসে “ব্রহ্মসূত্র”। উপনিষদের শিক্ষাগুলিকে সংক্ষেপে ধরে রাখতেই ব্রহ্মসূত্রের সৃষ্টি। মানুষের সাথে পৃথিবীর কী সম্পর্ক তাই নিয়ে এই ব্রহ্মসূত্র।
বেদান্তসুত্রঃ ব্রহ্মসূত্রকে অনেক সময় বেদান্তসূত্র বলা হয়। বেদান্ত কথার অর্থ হল বেদের অন্ত অর্থাৎ বেদের শেষভাগ। যেহেতু ব্রহ্মসূত্রগুলি উপনিষদের মূলশিক্ষা ধরে রাখে ও উপনিষদের সাথে একটি সূত্রপাত ঘটায় তাই একে বেদান্তসূত্র বলে।
বেদান্তসূত্রের শিক্ষাসহ ব্যাখ্যা যুগে যুগে নানা দার্শনিক করে গেছেন। এদের মধ্যে শঙ্করাচার্য, রামানুজ, মহাদেব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাগুলি থেকেই নানারকম বেদান্ত-দর্শনের জন্ম হয়েছে।
পুরাণঃ এরপর আসা যাক পুরাণ সম্বন্ধে। পুরাণে গল্প-গাঁথার মাধ্যমে বেদশিক্ষাকে রাজা মহারাজা, যুদ্ধ, ভগবান, সন্ন্যাসী ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করার চেষ্টা করা হয়েছে। মূলত একে সাধারণ শিক্ষার পুস্তক হিসেবে ধরা যেতে পারে অনেকটা সহজ পাঠের মত। আমাদের জানা প্রহলাদ, ভরত ইত্যাদি পুরাণের গল্প। পুরাণের ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। এটি মূলত কাল্পনিক। আদতে এরকম কোন ঘটনা ঘটেছিল তা জোর গলায় কেউই স্বীকার করতে পারেন না। যেহেতু সাধারণ মানুষের জন্য পুরাণগুলি লেখা হয়েছিল তাই হয়তো তখনকার সামাজিক অবস্থার একটা ছবি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ইতিহাস হিসাবে একে গণ্য না করাই ভালো।
পুরাণগুলিতে নানারকম অবতারের গল্প-গাঁথা আছে। এমনকি সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধকে হিন্দুদের অবতার হিসেবে দেখানো হয়েছে। জয়দেব তাঁর গীতগোবিন্দ গ্রন্থে বিষ্ণুর বর্ণনা করেছেন বুদ্ধের অবতার হিসেবে। এইভাবে দেখতে গিয়ে বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের সাথে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। যদিও অনেকটাই মিল রয়েছে এদের। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ হিন্দু হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যদিও বৈষ্ণব এবং জৈনদের থেকে বৌদ্ধরা একটু আলাদা। কারণ বৌদ্ধরা বেদের চরম সত্যকে স্বীকার করেনা। এই অবতারগুলির বর্ণনা ও ঘটনার দিকে নজর দিলে কোন সঠিক ভূগোল পাওয়া যায় না। অর্থাৎ তারা কোথায় কখন কিভাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেই ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে পুরাণ তাই তৎকালীন সামাজিক পরিচয় বহন করে।
বিষ্ণু এবং ভাগবত মূল দুটি পুরাণ। মোট ১৮ টি পুরাণ রয়েছে। ভাগবত পুরাণের স্থান রামায়ণ এবং মহাভারতের সাথেই করা হয়ে থাকে।
আগমঃ এর পরেই আসছে সাধারণ সাধন-শাস্ত্র। যেগুলোকে আগম বলা হয়। উপনিষদের মত আগমের সংখ্যাও বেশ কয়েকটি। আগমগুলিকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে -- বিষ্ণু, শিব ও শক্তি। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তাই মূলত তিনটি ভাগ দেখা যায় যথা বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত। শাক্ত-আগম মূলত তন্ত্র শাস্ত্র। বেদের মত আগমগুলিও তিনটি ভাগে বিভক্ত -- দর্শন, মানসিক বিকাশ ও ধর্মীয় আচার আচরণ। এইগুলি মূলত ব্যবহারিক শিক্ষাদান করে। এইসব শাস্ত্রেগুলির অনুপ্রেরণায় লোকসাহিত্যে ধর্মীয় কাব্য ও সাহিত্যের প্রচার এবং প্রসার ঘটেছিল। যা মূলত আঞ্চলিক ভাষাগুলির উন্নতি সাধনের সহায়ক হয়েছে।
যেহেতু হিন্দুধর্মের শুরুর অনেকটা সময় সেরকম আলাদা কোনো ধর্মীয় অস্তিত্ব ছিলনা তাই বৈদিক গ্রন্থগুলির মধ্যে কখনই অন্য ধর্মকে নিচু করে দেখানো বা অন্য ধর্মের থেকে কিভাবে হিন্দুধর্মকে বাঁচাতে হবে তার নির্দেশনামা নেই। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্তের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব খুঁজে পাওয়া যায়। নানা সময়ে একে অপরকে বদলে ফেলার চেষ্টা হিন্দুধর্মের ভেতরে চলেছে ব্যাপক হারে। কখনো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে বা কখনো ধর্মীয় আচার আচরণ বদলে এক বিশ্বাস থেকে অন্য মতাবলম্বী হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।
আমরা শেষ আলোচনা করব দর্শন নিয়ে। দর্শনের মাধ্যমেই মানুষ হয়ে উঠল যুক্তিবাদী। দর্শনের থেকেই তৈরি হল বিভিন্ন মতবাদ। যদি পুরাণকে কল্পনা, আগমকে হৃদয় দিয়ে বিচার করতে হয় তবে দর্শন হল তার যুক্তি। হিন্দুধর্মে ছয় রকম দর্শন (ষড়দর্শন) পাওয়া যায় -- ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা এবং বেদান্ত। এগুলি নানা সময়ে নানা শিক্ষাগুরু দ্বারা শুরু হয়। যেমন ন্যায়শাস্ত্র প্রণেতা ছিলেন গৌতম, বৈশেষিক কান্ড, কপিল যোগ, পতঞ্জলি মীমাংসা, যামিনী বেদান্ত ইত্যাদি।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দর্শন তাদের গুরুত্ব পেয়েছিল। আজকে যুগে দাঁড়িয়ে বেদান্ত দর্শন একমাত্র যুগোপযোগী রয়ে গেছে, এরকারণ হিসেবে বেদান্ত দর্শনের উৎপত্তি উপনিষদকে দায়ী করা হয়। সরাসরি উপনিষদ থেকে সৃষ্টি হওয়া এই বেদান্ত দর্শন আজও বহু প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার মানবজীবনে এমন অনেক প্রশ্ন আছে যার সরাসরি উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না।
বহু ঘাত-প্রতিঘাতের পর আজও বেদান্ত দর্শন নানাভাবে চর্চিত হয়। এক মূল কারন শঙ্করাচার্য প্রণীত সুবিশাল পুস্তকরাজি। এর বহুপরে বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন আজও যুগোপযোগী করে বেদান্তের চর্চা ও ব্যাখ্যা করে চলেছে। তাই আজও বেদান্ত-দর্শন স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
আমি আমার মত করে সুবিশাল এই বৈদিক সাহিত্যকে ১৮০০ শব্দের মধ্যে ধরার চেষ্টা করেছি। যেহেতু এর চর্চা কমে আসছে তাই প্রথাগত জ্ঞান না থাকার জন্যে সহজেই আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি। অনেক সময় বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করা হচ্ছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কেবল শ্লোক মুখস্থ করলে চলবে না, নিজের মত করে এর সমকালীন প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করতে হবে। সকলকেই যে এই সমুদ্রে অবগাহণ করতেই হবে এমন দিব্বি না করলেও চলবে। বরং ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে নাড়াঘাটা বা অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কোন অর্থ হয় না। সময় সুযোগ হলে পড়াশুনা করে তবেই ময়দানে নামা দরকার, নইলে বিভ্রান্তি আসবে।।
--- ঋজু ঘোষ, ২রা মে, ২০২১, ব্যাঙ্গালোর
খুব ভাল লিখেছিস। আমি চাইবো তুই এই সম্পর্কে আরও বেশি লেখ যা, এর প্রয়োজন।
ReplyDeleteসুন্দর লেখা
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete