ডক্টর কলিতা


আমার প্রথম চাকরির প্রথম পোস্টিং ছিল মিজোরাম রাজ্যের রাজধানী আইজল। 


।।১।।


স্থলপথে আইজল পৌঁছতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হত। প্রথমে পৌঁছে গেলাম আসামের রাজধানী গৌহাটি শহরে। এই শহর থেকে রোজ সন্ধ্যেবেলা একদল বাস বেরিয়ে পড়ত শিলচর নামক প্রান্তিক এক শহরের উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তাটাই অপরূপ মনোরম দৃশ্যে ভরা। সাথে যুক্ত হত মৃত্যুভয় সেইসময় বোড়োল্যান্ড আন্দোলন একেবারে চরমে। মাঝে মাঝেই লুটপাট ও সাধারণ যাত্রীদের মেরে ফেলার খবর পাওয়া যেত, তাই বাসগুলি সন্ধ্যাবেলা গৌহাটি শহর থেকে একসাথে বের হত। আর মাঝের কিছু বাসে সশস্ত্র সিআরপিএফ জওয়ান যাত্রীদের সঙ্গে বসে থাকতেন। এদের কাজ ছিল বিপদ দেখলে প্রতিআক্রমণ করা। যেহেতু সারারাত বাসগুলি চলার পরে সক্কালবেলা  শিলচর শহরে পৌঁছে যেত, তাই এই মেঘালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখার অবকাশ থাকত না। যাই হোক সন্ধ্যেবেলায় গৌহাটি শহরের বিরক্তিকর জ্যাম কাটিয়ে বেরোতে বেরোতেই রাত হয়ে যেত। তারপর পথের ধারে কোন ধাবায় বাসগুলোকে দাঁড় করিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করত যাত্রীরা যে যার নিজেদের মত। এইসব করে বের হতে হতে প্রায় রাত এগারটা হয়ে যেত। এরপর ধীরগতিতে সারারাত ধরে বাসের কনভয় মেঘালয়ের পার্বত্য আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এগিয়ে চলত। মাঝরাতে শিলং শহর পার হত। এইসব শহরগুলিতে দিনের বেলায় বড় বড় টুরিস্ট বাসগুলি চললে সাধারণ শহরবাসীর নড়াচড়া করার জায়গা থাকবেনা, তাই কেবলমাত্র রাতের বেলায় নির্জন পথ দিয়েই এই বাসগুলি বেড়িয়ে যেতে পারে। কোন কারনে যদি কোন বাস সকালবেলায় শহরের প্রান্তে এসে পড়ে তাকে রাত অব্দি অপেক্ষা করতে হবে শহর পার হবার জন্য। এইসব কারণে মেঘালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা বাস যাত্রীর ভাগ্যে আর হয়ে ওঠে না। আমাদের বাস ভালোই চলছিল। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে দেখা গেল একটি ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না, তাই বাসটিকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে পেছনের বাসগুলিকে পার হতে দেওয়া হল। এইসব করতে গিয়ে যে ঘটনাটা ঘটল তা হল আমরা বাকি কনভয় থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। কিছু যাত্রীকে এদিক ওদিক অন্য বাসে ব্যবস্থা করে দেওয়া হল আর আমরা কয়েকজন পড়ে রইলাম পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়। যদি কোন বাস খালি থাকে তবে হয়তো আমরা সেখানে জায়গা পেয়ে যেতে পারি। ঐরকম নির্জন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে মেঘালয়ের অরণ্য -- যেখানে সারি সারি সুপারি গাছের মাঝে অল্প মেঘের সাদা আলো ফুটে উঠেছে, সেইখানে এইরকম নির্জন বাসে মাত্র কয়েকজন অসহায় যাত্রী কীইবা আর করতে পারে? এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি ছিল না নিরাপত্তার কারণে। অগত্যা বাসের ওঠার সিঁড়ির মধ্যে বসে অন্ধকারে যেটুকু প্রকৃতির শোভা উপভোগ করা যায় সেটাই করছিলাম। প্রায় কয়েক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করার পরে আরও একটি কনভয় এসে গেল। এ যাত্রায় সকলেই এদিক-ওদিক জায়গা পেয়ে গেল আমিও একটি বাসে ড্রাইভারের পাশে বসার সুযোগ পেলাম। আমার পাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে একজন বসেছিলেন তাঁর পায়ের দিকে একটি ব্যাগ রাখা ছিল। তিনি আমাকে দেখামাত্র যাতে আমি বসতে পারি সেইজন্য তার ব্যাগটি সরাচ্ছিলেন এবং সরাতে গিয়ে চেন খুলে যে জিনিসটি বের করে আনলেন তাহল লাইট মেশিনগান। তখনই বুঝলাম যে আমি একজন সিআরপিএফ জওয়ানের ঠিক পাশেই বসে যাচ্ছি। 


এতক্ষণ ফাঁকায় তিন-চারজন মিলে যে ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম তার তুলনায় বেশি নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় চলে এসেছি মনে হল।

-----------------

।।২।।


এই সব বাস বিভ্রাটের ফলে একটি উপকার হল। যেহেতু আমরা পরবর্তী কনভয়ের সঙ্গে এসেছি তাই ভোররাতে কিছুটা মেঘালয় সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয়ে গেল। উত্তর-পূর্ব ভারতে সূর্যোদয় তুলনায় তাড়াতাড়ি হয় এরফলে শিলং পেরিয়ে আবার যখন মেঘালয়ের জঙ্গলে বাস প্রবেশ করলো তখন সারি সারি সুপুরি গাছের ফাঁক দিয়ে অল্প ভোরের আলো ফুটে উঠছে, কিছু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, ভোরের আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে যে পাহাড় সবুজ যে রং তখনো কালচে হয়ে ধরা পড়ছে -- এক মনোরম সুন্দর দৃশ্য। এইসব ভাষায় লিখে প্রকাশ করার মতো কলমের জোর আমার নেই অগত্যা স্বচক্ষে দেখার রেকমেন্ডেশন থাকলো। 


সকালবেলা শিলচর শহর পৌঁছে গেলাম। এর পরবর্তী যাত্রা শিলচর থেকে মিজোরামের রাজধানী আইজল শহর। অনেকটা পথ, প্রায় ৬ ঘন্টার রাস্তা টাটা সুমো করে যেতে হবে। বেশ কয়েকটি পাহাড় ডিঙিয়ে তবেই আইজল পৌঁছানো যায়। কথা হল, দুপুরবেলায় বের হব আর রাতেই পৌঁছে যাব আইজল। 


ব্রেকফাস্ট সেরে ফেললাম একটি রেস্টুরেন্টে। কথায় কথায় জানতে পারলাম সামান্য স্নান ও বিশ্রামের জন্য অর্ধেক দিনের হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়। রাস্তার দুপাশে ছোটখাটো এই ধরনের অনেকগুলি হোটেল ছিল। একটিতে ঢুকে পড়লাম। পোশাক সামান্য অদল বদল করে বেরিয়ে পড়লাম একটু শহরটাকে টহল দেওয়ার জন্য। শিলচর শহর মূলত বাঙালি অধ্যুষিত। কিন্তু যে বাংলা ভাষায় আমরা লেখালেখি করি তার সাথে এর বিস্তর ফারাক। সিলেটি বাংলা খোদ বাঙালির বোঝার সাধ্যের বাইরে। আশপাশের পথচলতি মানুষের ভাষার আদান-প্রদান শুনে আমি খুব একটা উৎসাহ পেলাম না। সোজা হিন্দি ভাষায় নিজেকে উপস্থাপিত করলাম। দেখলাম এখানে অনেকেই হিন্দি বেশ ভালোই বোঝে আর উত্তরও দিতে পারে অল্পস্বল্প। অন্তত আমার কাছে সিলেটি ভাষায় বার্তালাপ চালানোর দুঃসাধ্য চেষ্টা থেকে হিন্দি অনেক বেশি সহজ উপায় বলে মনে হল। 


শহর দেখার দু রকম পন্থা আছে। এক, পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরা। দুই, কোন রিক্সা বা ওই জাতীয় ধীর গতির যানবাহন ভাড়া করে চালকের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাওয়া। যেহেতু আমার হাতে কম সময় ছিল তাই একটি রিক্সা ভাড়া করে ফেললাম ঘন্টা হিসেবে যদিও আমি মাত্র একঘন্টা ঘুরতে পেরেছিলাম। কারণ হাতে সময় কম ছিল। তবুও বেশ কিছু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পরে এটা বুঝলাম যে আমি ঠিক যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি সেটি অত্যন্ত ব্যস্ত শহুরে একটি স্থান। যেখানে আসামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রোমান্টিক ব্যাপারটি একেবারেই নেই। তাই অহেতুক বেশি ঘোরাঘুরি করে নতুন কিছু দেখার মতন কিছু পাব না। এরমানে এই নয় যে শিলচরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নেই, হয়তো অনেকটা পথ গেলে আমি শিলচর শহরের বাইরে প্রকৃতির কাছে পৌঁছাতে পারতাম। তার জন্য যে ধরনের যানবাহন ও সময় দরকার ছিল তা আমার কাছে ছিল না বলে শহরেই ঘোরাঘুরি করার পরে হোটেলে ফিরে এলাম। 


আরও একটি কারণ এরপরে লম্বা রাস্তা পার হতে হবে আমাকে আইজল শহরে পৌঁছানোর জন্য।

-----------------

।।৩।।


শিলচর থেকে আইজল শহর যাবে টাটা সুমো। গৌহাটি থেকে আসা বাস যেখানে শিলচরে নামিয়ে দিল সেখান থেকেই টাটা সুমোর টিকিট কেটে হোটেলে ঢুকেছিলাম। টিকিট কাউন্টারের সামনে সার সার এইরকম অনেকগুলি টাটা সুমো দাঁড়িয়েছিল যারা সবাই আইজল ও মিজোরামের বিভিন্ন জায়গায় যাবে।


আইজল যেতে গেলে ভারতীয় নাগরিক হলেই কেবল চলবে না, সঙ্গে লাগবে এক ধরনের পারমিট যাকে বলা হয় "ইনার লাইন পারমিট"। আকাশপথে আইজল গেলে যদি কেউ কলকাতা থেকে উড়োজাহাজে করে আইজল বিমানবন্দরে অবতরণ করে তবে বিমানবন্দর থেকেই পরিচয়পত্র দেখিয়ে এই ইনার লাইন পারমিট তৈরি করে নেওয়া যায়। আমার কাজ যেহেতু ভারত সরকারের মানবসম্পদ দপ্তরের ছিল তাই আমার ইনার লাইন পারমিট গৌহাটির আইজল সরকারের অফিসে রাখাই ছিল। গৌহাটি থাকাকালীন আমি সেটি সংগ্রহ করে নিই। এই পারমিটটি আমার কাছে এখনো সযত্নে রাখা আছে। একটি A4 সাইজের কাগজে টাইপ করা ও সাথে পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগানো। কবে থেকে কবে আমি মিজোরাম রাজ্যের থাকতে পারি এবং কী কারনে এসেছি -- সেইসব বিস্তারিত লেখা থাকত। মিজোরাম রাজ্যের সীমানায় প্রত্যেক যাত্রীকে এই ধরনের কাগজ দেখাতে হত। মিজোরামের বাসিন্দা হলে তাকে আলাদা কোন কাগজ ব্যবহার করতে হত না। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক রাজ্যেই এই ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে। 


টাটা সুমো গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়াও মোট ৬ জন যাত্রী বসতে পারত। আমি পেছনে দুজনের সঙ্গে বসেছিলাম কথায় কথায় বুঝলাম একজন আইজলে কর্মসূত্রে বসবাস করেন ও কাজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছেন ছুটির পরে, আর আরেকজন আইজলের সীমান্তে অবস্থিত একটি পশুচিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর কলিতা। এঁদের সঙ্গে আমার মোটামুটি হিন্দি ও ইংরেজি মিলিয়ে কথাবার্তা চলছে। অসমে অহমিয়া ছাড়াও ইংরেজি বেশ জোরের সঙ্গে পড়ানো হয়। এখানে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা ও সাহিত্যিক মূল্যায়ন জ্ঞান বেশ উঁচুমানের। ডক্টর কলিতার সঙ্গে আমি ইংরেজিতেই কথা বলছিলাম। তার কারণ হিন্দি ওঁর ঠিকমতো বলতে পারার ক্ষমতা ছিল না আর আমার ইংরেজিটাও যথেষ্ট কাজ চালানো ভাঙ্গা ভাঙ্গাই ছিল। কিন্তু একজন ভদ্র নম্র স্বভাবের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর জন্যে ভাষা ব্যবধান কোন ব্যাপারই নয়। 


আমরা যে সময় বেরিয়েছিলাম তাতে সন্ধ্যের ঠিক পরপরই আইজল পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিপর্যয় পাশ ছাড়ছে না। 


শিলচর শহর থেকে আইজল যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গ্রাম পড়ে। আর গ্রামগুলিতে বড় রাস্তার ধারে হাট জাতীয় ছোট ছোট বাজার দেখা যায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃষ্টি পৃথিবী বিখ্যাত। এইখানেই চেরাপুঞ্জিতে সর্বাধিক বৃষ্টি হয় কখনো কখনো, আর মাটিও তুলনামূলকভাবে নরম। যেহেতু বাজার এলাকা এবং সেখানে লোকজনের চলাচল একটু বেশি তাই সেই অঞ্চলগুলির রাস্তা একটু ভাঙ্গা থাকে। এইরকম জায়গায় বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই, তারপর সার সার মাল বোঝাই ট্রাক চলছে কোন এক অজানা উদ্দেশ্যে। এইরকম বিচিত্র সব যানবাহনের রাজ্যে আমাদের ক্যারাভান আইজল এর পথে এগিয়ে চলেছে। বাজারের কাছাকাছি আসার পরে হঠাৎ অনেক গাড়ির পেছনে আমাদের টাটা সুমো গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। বোঝা যাচ্ছে না সামনে কী হয়েছে? এইরকম ঘটনা রাস্তায় হামেশাই ঘটে থাকে বলে আমাদের গাড়ির চালকের তেমন হেলদোল দেখা গেল না। তিনি বরং গাড়ি থেকে বেরিয়ে পান দোকানে গিয়ে পান খাওয়া শুরু করলেন। বোঝা গেল এই ব্যাপারটা মিটতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে আর আমরা গাড়ির মধ্যে একে অপরের সঙ্গে গল্প করে চলেছি। পরিচয় বাড়ছে সহযাত্রীদের। আমরা অন্য সিটের লোকজনের সঙ্গে বেশ জমিয়ে কথাবার্তা বলছি। সময় কাটানোর এর চেয়ে ভালো উপায় নেই। গাড়ি থেকে বের হবার জো নেই। তার কারণ নামলেই থকথকে কাদা রাস্তায় ও রাস্তার পাশের মাটিতে। যেহেতু মাটি নরম অনেকটা এঁটেল মাটি ধরনের তাই পা ডুবে যেতে পারে এবং তাতে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার সৃষ্টি হবে। 


এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে আমাদের অধৈর্য হবার পালা। আমাদের জোরাজুরিতেই গাড়ির চালক রাস্তার পাশ দিয়ে খালি পায়ে একটু এগিয়ে গেলেন। তাঁর চলার গতি অনেকটাই ধীর, যেহেতু জলকাদায় ভর্তি সারা রাস্তা। বেশ কিছুক্ষণ পরে নিরাশ মুখে ফিরে এলেন এবং জানালেন একটি বড় মাল বোঝাই ট্রাক কাদায় আটকে গেছে। ট্রাকটি না সরা পর্যন্ত কোন গাড়ি এগোতে পারছে না। 


এই মুহূর্তে আমরা লক্ষ করলাম যে এটি একটি সরু রাস্তা এবং তাতে কোনো মতে একটি বড়গাড়ি ও ছোটগাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে। তাই হাইওয়ের নিয়ম অনুযায়ী যারা বামদিকে আছে তারা কখনই ওভারটেক করবে না যেহেতু ডানদিক থেকে আসা উল্টোদিকের গাড়িগুলি তার চলার পথে আটকে না পড়ে। আমরা দেখছিলাম ডানদিকের রাস্তাটি একেবারে ফাঁকা ও আমরা যদি গাড়িটাকে বার করে ডানদিক ধরে এগোতে থাকি তাহলে হয়তো ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের চালক কিন্তু অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তখনই লক্ষ করলাম আরেকটি আমাদেরই মত টাটা সুমো এইরকম ডানপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল, অর্থাৎ সে ভেবেই নিয়েছিল যে ট্রাকটি আজকের মতো ঠিক হচ্ছেনা এবং যতক্ষণ না ঠিক হবে এই গাড়িগুলো বের হতে পারবে না। আমরাও ড্রাইভারকে জোরাজুরি করার ফলে ড্রাইভার গাড়িটাকে আগে-পিছে করে বের হবার উদ্যোগ নিল। তখনই দেখা গেল আমাদের ঠিক সামনে দিয়েই যে টাটা সুমোটি ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছিল সেটি কিছুদুর গিয়ে আটকে পড়েছে। কাদায় তার পিছনের চাকা ঘুরছে এবং গাড়িটি এগোতে পারছে না। রাস্তার অবস্থা যথেষ্টই খারাপ বলে মনে হল। টাটা সুমো ট্রাকের থেকে অনেকটাই হালকা ও কাদায় আটকে গেছে। এই অবস্থায় আমাদের সহায় হলেন গ্রামবাসীরা। কোথা থেকে বাঁশের মাচা চলে এলো। রাস্তা বেঁধে ফেলা হলো। একটা লম্বা রেড কার্পেট জাতীয় বাঁশের মাচা দিয়ে একটা পথ তৈরী হয়ে গেল। এতে সুবিধে হল সরাসরি কাদায় চাকার ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। এর ফলে এক এক করে টাটা সুমো বেরিয়ে যেতে পারবে। বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়ো না করে অত্যন্ত সভ্য ভদ্রভাবে একটি একটি করে টাটা সুমো এগোতে থাকলো অত্যন্ত ধীরে ধীরে। কারণ বাঁশগুলি ভেঙে গেলে এতে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা একে একে ট্রাকটাকে পার হয়ে গেলাম। 


এইসব করতে করতে আমাদের তিন থেকে চার ঘন্টা দেরি হয়ে গেল। অর্থাৎ আইজল শহরে পৌঁছে পৌঁছতে আমাদের বেশ রাত হয়ে যাবে। আইজল শহরটি আমার কাছে একেবারেই অচেনা।


এইবার আমার আশঙ্কা বাড়তে শুরু করেছে। যদিও আমি কোন হোটেলে থাকবো তার ফোন নম্বর এবং ঠিকানা নিয়ে এসেছি। কিন্তু কোনো অগ্রিম বুকিং ছিল না অর্থাৎ সরাসরি গিয়ে হোটেলে উঠবো। পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধ্যে হলেই তা গভীর রাত। তারপর যদি আমি গভীর রাতে সেখানে পৌঁছায়ই তাহলে তো কথাই নেই। হোটেল যদি বন্ধ থাকে তাহলে? 


এইসব আশঙ্কা নিজের মনে না রেখে ঠিক করলাম সহযাত্রীদের সঙ্গে শেয়ার করি। ডক্টর কলিতাকে বেশ ভয়ের সঙ্গে কথাগুলো বললাম। ডক্টর কলিতা আমাকে আশ্বাস যোগানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলেন ক্রমাগত, কিন্তু আমিও নাছোড়। অর্থাৎ কিছুতেই আশঙ্কা তাড়াতে পারছিলাম না। 


এইসব চলছে তারই মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম মিজোরাম রাজ্যের সীমান্তে। সেখানেও সার সার গাড়ি। আমার ভয় হলো আবার কী কোন ব্রেকডাউন? ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার বলল, সামনেই চেকপোস্ট যেখানে মিজোরাম সরকারের পুলিশ কাগজপত্র দেখছে, একটু সময় লাগবে। তবে এটা কোন ব্রেকডাউন নয় -- আশ্বস্ত হলাম। 


যতটা তাড়াতাড়ি হওয়া সম্ভব বলে চালকের কথায় মনে হয়েছিল ততটা তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটল না কারণ প্রত্যেকটি গাড়ির প্রত্যেকটি যাত্রীকে দরকারি কাগজপত্র দেখাতে হচ্ছিল। যা দেখতে যথেষ্ট সময় লাগা দরকার। এরপর আমরাও চেকপোস্ট পেরিয়ে এলাম‌।


মিজোরাম রাজ্যের একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে আইজল শহর। ভারতের ম্যাপ দেখলে দেখা যাবে শিলচর শেষ হওয়ার পরেই মিজোরাম শুরু হয়। অনেকটা মিজোরাম রাজ্যের রাস্তা অতিক্রম করার পরে আইজল আসে। পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপের সঙ্গে তুলনা করলে যদি আমরা সিকিম থেকে দার্জিলিং দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করি, তবে কলকাতা যেরকম একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে, সেইরকমই মিজোরামের রাজধানী আইজল।


আমার হাঁড়ির হাল দেখে ডক্টর কলিতা বলেই বসলেন আর কিছুক্ষণ পরেই ওঁর কোয়ার্টার আসছে। আমি যদি রাত কাটাতে ইচ্ছুক হই তবে সেখানেই রাত কাটিয়ে পরদিন সকালবেলায় আইজল এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে পারি। এইরকম অনেক গাড়ি আইজলে যাতায়াত করে সারারাত ধরে, তাই কোন একটি গাড়িতে আমি আমার ব্যবস্থা করে নিতে পারব। সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। আজকে ভাবি, এইরকম পথে অজানা অচেনা কারুর সঙ্গে কেবলমাত্র গাড়িতে দু'একটি কথা বলার পরে আমি কী কাউকে নিজের বাড়িতে এইভাবে আপ্যায়ন করতে পারব? পারবো না। তার কারণ আমি অনেক বেশি জটিল শহুরে মানসিকতার। এখানেই উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের সঙ্গে বাকি ভারতবর্ষের মানুষের পার্থক্য। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ আজও অনেকটাই সহজ সরল সাদাসিধে, যাকে আমরা অসহায়তা বলেও মাঝে মাঝে ভুল করে থাকি। আসলে তাঁদের জীবনেও জটিলতা আছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জটিলতা অনেকটাই বেশি ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় তবুও তাঁদের জীবনযাত্রায় সেই জটিলতা এখনো সেইরকম ভাবে প্রবেশ করতে পারেনি, মলিন করতে পারেনি তাঁদের মানসিক চেতনাকে, মানবতাকে, ভালোবাসার ইচ্ছেকে। ডক্টর কলিতা আমার কাছে সেই মুহুর্তে একজন দেবদূত ছিলেন।


পৌঁছে গেলাম ডক্টর কলিতার হোস্টেলে। তিনি আমাকে নিয়ে প্রবেশ করলেন সঙ্গে তাঁর সহকর্মীরাও বসবাস করত। আমাকে তাঁর নিজের ঘরটি ছেড়ে দিলেন। আমি শোবার সময় লক্ষ করলাম টেবিলেই একজন নব দম্পতির ছবি। ডক্টর কলিতাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম কিছুদিন আগেই ওঁর বিয়ে হয়েছে এবং এটা তাদেরই ছবি। প্রার্থনা করলাম ওঁর বিবাহিত জীবন যেন সুখের হয়। এর চেয়ে বেশি দেওয়ার মত আমার কিছু ছিল না।


দীর্ঘ যাত্রার পর একটি নিস্তরঙ্গ ঘুম এল। সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন ওই বাড়ির সকলেই উঠে পড়েছেন। এঁরা প্রত্যেকেই সেই মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরিচয়পর্ব শেষে সামান্য চা-জল খাবারের আয়োজন সম্পূর্ণ করার পরে হাত নাড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম ব্যাগ নিয়ে। 


বড় রাস্তার ধারে গাড়ি চলছে। ডক্টর কলিতা আমার সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। গাড়ি থামিয়ে কিছু একটা বললেন এবং আমাকে উঠিয়ে দিলেন। আমি হাত নেড়ে বিদায় জানালাম সেই মহান দেবদূতকে। তারপর আমার ডক্টর কলিতার সঙ্গে কথাও হয়নি দেখাও হয়নি আর। চেষ্টা করেছিলাম ই-মেইলে যোগাযোগ করার কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। জানিনা সেই ই-মেইলটি এখনো কাজ করছে কিনা। 


আমি আজও ডক্টর কলিতাকে খুঁজে চলেছি। একবার দেখা পেলে অবশ্যই মাথা নুইয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব।


(চলবে)


Comments

Popular posts from this blog

ভিনসেন্ট ভ্যানগখ এর সাথে

ডাচ গোল্ডেন এজ, রেমব্রান্ট ও নাইট ওয়াচ