আমাদের স্কুল - জেনকিন্স স্কুল কোচবিহার
------------------------
- ১ - জলের ট্যাঙ্ক
------------------------
রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রথাগত শিক্ষাদীক্ষা থেকে বহুদূরে থাকলেও পরবর্তীকালে ছাতিমতলা বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে হিসেবে। এই রবীন্দ্রনাথের জন্মবর্ষেই আমাদের স্কুল জেনকিন্স বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। আমাদের ছিল দেবদারু গাছ। সেই গাছের নিচে অবশ্য ক্লাস হতো না, কিন্তু সাইকেল থাকত। মাঝে মধ্যে দু’একটা সাইকেল চুরি হয়ে যেত। সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল যদি কোন অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রের সাইকেল চুরি হত। আমি নিজে একবার এইরকম চুরির খবর পেয়ে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। শেষ সম্বল হারিয়ে ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে থাকা দাদাটির দিকে তাকিয়ে থাকার মত ক্ষমতা আমার ছিলনা।
আমাদের স্কুলে একটি লাইব্রেরী ছিল। আমরা স্কুল জীবনে যার অস্তিত্ব সন্মন্ধে কোনো ধারনাই করতে পারিনি। পড়াশোনার বাইরে যে জ্ঞানের ভান্ডার থাকে তা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে পড়ে বা পাড়ার লাইব্রেরী থেকেই মেটাতে হত। কিন্তু সেই স্কুল লাইব্রেরির অভাব মিটিয়েছিল একটি জলের ট্যাঙ্ক। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি আদর্শ কিউবিক আকৃতির ট্যাঙ্কটি জাল দিয়ে ঘেরা থাকত আর উপরে ছিল টিনের চাল । হাইজিন বলতে আজকের যুগে আমরা যা বুঝি তার ছিটেফোঁটাও এখানে ছিল না। উঁকি মেরে উপর থেকে দেখা যেত ব্যাঙ জলে সাঁতার কাটছে। আমি এখান থেকে ব্যাঙ পাকড়াও করে জীবনবিজ্ঞান প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে নিয়ে যেতাম। আজকালকার দিনে এই ধরনের জলের ট্যাঙ্ক দেখলেই বাবা-মা সহ ছাত্রের হসপিটালে ভর্তি অবশ্যম্ভাবী, স্কুলে পড়ানো তো দূরের কথা। আমাদের মা-বাবারা এইসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাত না। পেট খারাপ হলে শাকপাতা খাইয়ে ঠিক করে দিত। আমরাও ১০ বছরের উপরে এই জল খেয়ে বেঁচে ছিলাম। জল খেয়ে মারা গেছে এরকম ঘটনা আমাদের সময় অন্তত ঘটেনি।
গোপনে খবর ছিল, আমাদের স্কুলের ছাত্ররা পড়াশোনায় এত উন্নতি করছে এই ট্যাঙ্কের জলের কল্যাণে। তাই আশপাশের স্কুলের ছাত্ররা মাঝেমাঝেই জল খাওয়ার জন্য চুপচাপ ঢুকে পড়ত। আমাদের প্রত্যেকটি বয়েজ স্কুলের একটি করে রাইভ্যাল গার্লস স্কুল ছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে বয়েজ স্কুলের ছেলেদের পরবর্তীকালে বিয়ে হত। শত্রুতা বিবাহের মাধ্যমে মিত্রতায় পরিণত করার যেয়ে প্রাচীন প্রথা রাজারা তৈরি করেছিলেন তাঁর সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। তরুণ শিক্ষক, তরুণী শিক্ষিকারাও পিছিয়ে থাকতেন না। আমাদের সময় এরকম শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ব্যর্থ প্রেমের মুচমুচে কাহিনী আনাচে-কানাচে ঘোরাঘুরি করত। শুনেছিলাম সেই গার্লস স্কুলের এক দিদিমণি এসে তাঁর ফুল লতাপাতা দিয়ে মোড়া জলের বোতলে দু-তিন ফোঁটা জল ভরে নিয়ে যেতেন আমাদের ট্যাঙ্ক থেকে। যদি বয়েজ স্কুলের থেকে কিছুটা উন্নতি করা যায়। যদিও সেই চেষ্টা এখনো চলছে।
আমাদের স্কুলের যুনিয়র সেকশন যেখানে হত সেটাই বোধহয় সবচেয়ে পুরনো বিল্ডিং ছিল। যাকে আমরা “টিনশেড” বলতাম। যেখানে ক্লাস থ্রী থেকে সেভেন অব্দি ছিল। এছাড়াও অষ্টম শ্রেণীর কয়েকটি সেকশন যা মাঝেমাঝেই স্থান বদল করত এদিক-ওদিক। টিনশেডের বিল্ডিংগুলি পরপর রো-হাউসের মত ছিল। আমাদের সময় এইসব ঘরে ফ্যান ছিল না। প্রত্যেক ঘরের পেছনদিকে বড় বড় জানালা এবং তাতে কোন শিক থাকত না। তারফলে মাঝেমধ্যেই অফ পিরিয়ডে আমরা জানলা দিয়ে নেমে পড়তাম। পেছনদিকে অদ্ভুত রকমের মায়াবী অলৌকিক পরিবেশ ছিল। কিছুটা ফাঁকা জায়গা তারপর উঁচু প্রাচীর যার ওপাশে চন্দনদিঘী। আর ছিল এক বিশাল বটগাছ। এই বটগাছের একপাশে কিছু ঘর ছিল। যেখানে মূলত হস্তশিল্পের ক্লাস হত। এরমধ্যে বেশ কিছু লেদ মেশিন ছিল আর ছিল কার্পেন্টারির যন্ত্রপাতি। আমাদের সময় স্পোর্টসে লং জাম্প করার জন্য একটি অংশকে গর্ত খুঁড়ে বালি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হত, যাতে ব্যথা না লাগে। এই ব্যাপারটি মূল মাঠে করলে ক্ষতি হতে পারে ভেবেই পেছেনের এই ছোট মাঠে ইভেন্টি আয়োজন করা হত। একবার স্কুলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। যেখানে প্রবীরবাবুর পরিচালনায় ‘নোপাসারান’ নামে এক নাটক অভিনীত হয়। এই নাটকে বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি ছিল বোধহয়। মনে আছে ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিওতে প্লেনের আওয়াজ রেকর্ড করে আবহ সৃষ্টি করেছিলেন স্যার। প্রচণ্ড গোলাগুলির একটা দৃশ্য ছিল যেখানে আমাদের এনসিসি ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা সত্যিকারের বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়েছিলেন এই জায়গাতেই একটি গর্ত খুঁড়ে। সে এক কেলেংকারী কান্ড। স্কুলের মধ্যে এরকম অদ্ভুত কীর্তিকলাপ প্রবীরবাবুর পক্ষেই সম্ভব। প্রবীরবাবু নিজে নাটক করতেন। যাত্রাদলে অট্টহাসির রোল করবেন বলে সেই হাসি প্র্যাকটিস করতে করতে আসল হাসিটাই যাত্রাদলের হাসির মতো হয়ে গেছিল।
এই প্রবীরবাবুর অট্টহাসি কতটা ভয়ঙ্কর ছিল তার একটা গল্প শোনাই। আমাদের স্কুলে একজন শিক্ষক নতুন জয়েন করেছেন। যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটি সাইকেল কিনেছেন। আমাদের শিক্ষকদের কমনরুম লালরঙের একটি পুরনো বিল্ডিংএ ছিল। ভিত বেশ উঁচু। বেশকিছু সিঁড়ি দিয়ে উঠে তবে বিল্ডিংয়ে ঢোকা যেত। শিক্ষকরা তাদের সাইকেল কমনরুমে রাখতেন। যাতে তা চুরি না যায়। নতুন স্যার তাঁর নতুন সাইকেল এডমায়ার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, এমন সময় প্রবীরবাবু পানের পিক ফেলার জন্য বাইরে এসে নতুন সাইকেল দেখেই নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠেছিলেন, ‘কি শঙ্কর নতুন সাইকেল হা-হা-হা (অট্টহাসি)।’ সেই পিলে চমকানো অট্টহাসিতে ঘাবড়ে গিয়ে স্যারের হাত থেকে সাইকেল পড়ে যায়।
------------------
- ২ - টিনশেড
------------------
উত্তর কোরিয়ার ডিক্টেটর কিম জং উন নিজের টয়লেট সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। এই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে সাংবাদিকরা জানতে পারে তার মলমূত্র ইত্যাদির নমুনা পরীক্ষা করে শরীরে দানাবাঁধা রোগ সম্বন্ধে সারা পৃথিবী ওয়াকিবহাল হয়ে পড়বে, এই আশঙ্কায় তিনি সাধারণ শৌচালয় ব্যবহার করেন না। আমার ধারণা অন্য। আমার ধারণা কিম জং উন জেনকিনস স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এবং তিনি ছাত্রজীবনে টিনশেডে পড়াশোনা করেছেন। এই টিনশেডের লাগোয়া টয়লেট নামক যে বস্তুটি ছিল সেটা যারা একবার দেখেছে তাদের এই গল্পটি কিছুটা হলেও ইঙ্গিত বহন করবে।
আমাদের স্কুলের কথা বললেই টিনশেডের কথা বারবার ঘুরেফিরে আসে। এর কারণ টিনশেডে আমাদের সময় তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি অব্দি ক্লাসগুলি হত। এই দীর্ঘ ছয় বছরের শিক্ষাজীবনে একজন শিশু তার কৈশোরের দোরগোড়ায় পদার্পণ করে। পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াও সে আরো অনেক ধরনের বিদ্যা সিনিয়ার বা অকালপক্ক বন্ধুদের কাছ থেকে গ্রহণ করে। এই ছয় বছরের শিক্ষাজীবনে তার এক আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। প্রাইমারি থেকে সে পৌঁছায় হাফ ইয়ারলি ও অ্যানুয়াল পরীক্ষার টেনশন মুখর জীবনে। আমাদের সময় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজী শিক্ষা চালু হত। এটাও একটা বিপুল পরিবর্তন। এরপরে সপ্তম শ্রেণীতে সংস্কৃত। মানে ধীরে ধীরে শিশুদের চপলতার অবকাশ কমতে থাকে। চলতে থাকে এক ধরনের প্রতিযোগিতা। অনেক তথাকথিত পেছনদিকে থাকা ছেলেরা এগিয়ে আসে সামনের দিকে, আবার প্রথম সারির বেশকিছু পিছিয়ে যায়। এই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার মধ্যে মানসিক ও শারীরিক আকারে বড় হতে থাকে একদল ভবিষ্যতের যুবক। তৃতীয় শ্রেণী থেকে বিদ্যালয় চালু হত বলে মূল ছাত্রগোষ্ঠীর বেশিরভাগ এই তৃতীয় শ্রেণীতেই ভর্তি হত। এরপর পঞ্চম শ্রেণীতে সামান্য কিছু ছাত্র নেওয়া হত, যেহেতু সেই সময় ক্লাস দুটি সেকশনে ভাগ হয়ে যেত। তারপর সপ্তম শ্রেণীতে আরও একবার নতুন ছাত্ররা আমন্ত্রিত হত। এই সবগুলি স্তরেই একটা সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের বিদ্যালয়ে স্থান হত। এতে বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলত। শহরের মোটামুটি সবাই এই স্কুলে পড়বে বলে প্রস্তুতি নিত। সেইসময় লটারি পদ্ধতির প্রচলন ছিল না বলে মেধাবী ছাত্ররাই কেবল স্কুলের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফল হত। আমরা যখন নবম-দশম শ্রেণীতে মাধ্যমিক দেব সেই সময় ক্লাসে মোটামুটি ১৫০ জন ছাত্র ছিল। এরা সকলেই জেলার সেরা ছাত্রদের মধ্যে স্থান পাবার যোগ্য। এর মাঝে দু’একজন সরকারি বদলি হয়ে আসা আমলাদের ছেলেপিলেরা ভর্তি হত, অথবা স্কুলের বদলি হয়ে আসা শিক্ষকদের সন্তান যারা মাঝের যেকোনো ক্লাস থেকেই শুরু করতে পারত।
টিনশেডের মাঠ লাগোয়া যে ঘরগুলো ছিল তা সরাসরি প্রধান শিক্ষকের ঘরের দরজার বিপরীত দিকে অবস্থান করত। মাঝখানে সবুজ ঘাসের মাঠ। তার ওপাশেই প্রধান শিক্ষকের ঘর। প্রধান শিক্ষক দরজার মুখে দাঁড়ালেই সমস্ত টিনশেড চুপচাপ হয়ে যেত। আমাদের প্রধান শিক্ষকের ডিসিপ্লিন নামক বস্তুটি নিয়ে এক ধরনের হিটলারি পরোয়ানা ছিল। স্কুল চলাকালীন মাঠের মাঝখান দিয়ে যাতায়াত করতে পারতাম না। কেবলমাত্র স্কুল চালু হওয়ার আগে, টিফিন পিরিওডে ও স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পরে মাঠে নামা যেত।
এই প্রধান শিক্ষকের ডিসিপ্লিন নিয়ে অনেক গল্প আছে। একবার আমাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যা আমাদের সময় প্রতিবছর হত না। শুরুর সময় ঠিক সকাল ১১ বেজে ০১ মিনিট। প্রত্যেক ছাত্রের অভিভাবকদের চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হত। সেই চিঠিগুলো আমরাই বাড়িতে নিয়ে যেতাম। তাতে স্পষ্ট লেখা থাকতো সকাল ১১ বেজে ০১ মিনিটে পতাকা উত্তোলন হবে। যেহেতু আমাদের সরকারি স্কুল এবং শহরের প্রথম ও প্রধান বিদ্যালয়, সেইজন্য শহরের উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা তখন ডিসি বলা হত এখন যা ডিএম বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর রেওয়াজ ছিল। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেন প্রধান অতিথি, সাথে প্রধান শিক্ষক দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর ছাত্ররা সমবেত জাতীয় সংগীত গাইত। এইভাবেই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হত। কিন্তু একবার প্রধান অতিথি কোন কারণে কাজে আটকে পড়ার দরুন হয়ত দেরি হচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু ১১ টা ০১ মিনিটে পতাকা উত্তোলন হবেই তাই প্রধান শিক্ষক নিজেই পতাকা উত্তোলনের জন্য উঠে পড়লেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রধান অতিথি হন্তদন্ত হয়ে স্কুলে প্রবেশ করছেন এই সময় ছাত্ররা জাতীয় সঙ্গীত শুরু করে দিয়েছে তাই তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন গেটের মুখে যেখানে তাঁর সরকারি লালবাতি গাড়ি তাঁকে নামিয়ে দেয়। প্রধান অতিথি ছাড়াই স্পোর্টস উদ্বোধন হয়ে গেছে এই দেখে তিনি যারপরনাই লজ্জিত হয়েছিলেন। হাত পায়ে ধরা বাকি রেখেছিলেন এবং প্রধান শিক্ষক মহাশয় তাঁর বক্তৃতায় আমাদের এবং প্রধান অতিথিকে এই কথা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ডিসিপ্লিনের সঙ্গে কোন কিছু কম্প্রোমাইজ করা যাবে না।
এহেন প্রধান শিক্ষকের জমানায় আমাদের টিনশেডের জানলা দিয়ে লাফানো বন্ধ হয়ে যায়। তার কারণ পিছন দিকের স্থানটিতে স্কুলের নতুন বিল্ডিং তৈরি হওয়া শুরু হয়। অনেকটা তাজমহলের মত প্রায় ২২ বছর লেগেছিল এই বিল্ডিং তৈরি হতে। আমরা সুযোগ পাইনি এই বিল্ডিঙ চালু অবস্থায় দেখে যাওয়ার। জানিনা কোন শাজাহান তার মমতাজের মৃত্যুর জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছিলেন তাজমহলের দরজা খোলার।
প্রধান শিক্ষকের সহকারী শিক্ষাকর্মী ছিলেন কমলা ভাই। আমরা সকলে তাকে এই নামেই ডাকতাম। আসল নাম কী ছিল এখন আর মনে পড়ছে না। ক্লাসে বসে আমরা প্রতিদিন দেখতে পেতাম কমলা ভাই একটি কমলা রঙের জগ থেকে জল ফেলে দিচ্ছেন, তারপর সেটি আবার জলের ট্যাঙ্ক থেকে ভরে হেড স্যারের ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। এটি তার ডেইলি রিচুয়াল্স এর মধ্যে পড়ত। সমবেত জাতীয় সংগীত শেষ করার পরে আমরা যে যার ক্লাসে লাইন করে সারিবদ্ধ অবস্থায় ঢুকে পরতাম এবং বেঞ্চে বসে সরাসরি হেডস্যারের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখতাম দরজাটা খুলে যাচ্ছে এবং কমলা ভাই তার প্রতিদিনকার কাজ নিয়ম করে একের পর এক করে চলেছেন। আগেরবার আমি জলের ট্যাংকের বিষয়ে কথা বলেছিলাম, সেই জলের ট্যাঙ্ক থেকে প্রধান শিক্ষক জল খেতেন। অনেকের ধারণা ছিল কমলা রঙের জগ থেকেই তার নাম কমলা ভাই।
কমলা ভাইয়ের বিষয়ে নানারকম মজার গল্প আছে। বিহার থেকে অত্যন্ত কম বয়সে ভাগ্যান্বেষণে কোচবিহারে পৌঁছান। তারপর পাকেচক্রে জেনকিন্স স্কুলে চাকরি পাওয়ার একটা সুযোগ আসে। যেহেতু চাকরির যোগ্য বয়সের থেকে তার বয়স কম ছিল তাই বয়স বাড়িয়ে চাকরিতে প্রবেশ করানো হয়। অর্থাৎ কমলা ভাইয়ের আসল বয়সের তুলনায় বেশি বয়স দেখায় তার সার্টিফিকেট। এর ফলস্বরূপ অবসরের বয়স ৬০ বছরের আগেই কমলা ভাইকে রিটায়ার করতে হয়। এই নিয়ে কমলা ভাই বেশ বিমর্ষ ছিলেন এবং শেষের দিকে বাবার কাছে রীতিমতো দুঃখ প্রকাশ করতেন যে তার বয়সের আগেই রিটায়ারমেন্ট নিতে হচ্ছে। শক্তপোক্ত চেহারার কমলা ভাই মেনে নিতে পারছিলেন না যে ৬০ বছর বয়েস হয়ে যাবার আগেই তাকে অবসর নিতে হবে আর তিনি বেকার হয়ে পড়বেন। বাবা বোঝানোর চেষ্টা করতেন কমলা ভাই যে বয়েসে চাকরী পেয়েছিলেন সেই সময় তার বয়সী কেউ মাইনে পেত না। এর উত্তরে কমলা ভাইয়ের যুক্তি ছিল এখন একদিনের বাজারের খরচ তখনকার একমাসের মাইনে থেকে বেশি।
(ক্রমশঃ)
দারুন ঋজু। চালিয়ে যা। অনেক কিছু মনে পরে গেল।
ReplyDelete