আমার দুর্গাপূজা
দুর্গাপূজা এলেই আমার মধ্যে সাংঘাতিক এক বৈরাগ্যের দর্শন অনুভূত হয়। সমস্ত বাহ্যিক আনন্দ উৎসবের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এমন নয় যে এর পেছনে কোন ঘোর কালো ইতিহাস আছে। এটা আমার মধ্যে স্কুল জীবনের মাঝামাঝি সময় থেকেই কেমন করে জানি চলে এসেছে। এক সময় বাড়িতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জামাকাপড় নেব না বলে ফতোয়া জারি করেছিলাম। পূজাবার্ষিকী কেনা হত একটা বা দুটো, সেটাই মূল আকর্ষণ ছিল। এছাড়া বাড়ির থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে দুইখানা পুজো মণ্ডপে ঢুঁ মারতাম ঠিকই কিন্তু সক্রিয় অংশগ্রহণ কখনোই করিনি। এটাও এক ধরনের বৈরাগ্য থেকেই এসেছিল।
এরপর চাকরি জীবনে নানা শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি। দুর্গাপূজার সময় যে একটা আমেজ পশ্চিমবাংলার প্রতিটি গ্রাম শহরের আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয় তা সাংঘাতিকভাবে অনুপস্থিত ভারতবর্ষের অন্য যেকোন শহরে। এর মূল কারণ হয়তো বাকিদের সামগ্রিক উৎসবে শামিল না হওয়া। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পূজা হলেও অবাঙালিরা তেমনভাবে এই পুজোয় নিজেদের ভাসিয়ে দেয় না। এর ফলে পুজোর যে একটা আলাদা আমেজ সেটা অনুভূত হয় না। একবার পুজোর সময় পাটনা শহরে ছিলাম। পুজোর চারদিন কেমন করে কেটে গেছিল তা বুঝতেই পারিনি।
পরবর্তীকালে কলকাতায় দুটো পুজোর সময় কাটিয়েছি। একবার টালিগঞ্জে আমরা তিনজন যে ফ্ল্যাটে থাকতাম সেই ফ্লাটে পূজা চলাকালীন একাই ছিলাম। প্রচণ্ড ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে খাবার-দাবার কিনে চার দিনের জন্য গুহাপ্রবেশ করেছিলাম। তখন ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ ছিলনা। তাই কেবল টিভি আর পূজাবার্ষিকী এই দুটোর উপর ভরসা করেই চারদিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল বেশকিছু ম্যারাথন ঘুম। আর একবার মাসির বাড়িতে কলকাতার বাগুইহাটি অঞ্চলে ছিলাম। মাসি জোর করে পুজো মণ্ডপে নিয়ে গিয়ে গেছিল আমাকে, কিন্তু ভিড় দেখে ভেতরে ঢোকার সাহস পাইনি। যদিও সময়টা দিনের বেলা ছিল তাও প্রচণ্ড ভিড়। তাই কলকাতার পুজো বলতে যে মাতামাতি এখন ফেসবুকের কল্যাণে দেখতে পাই তার অনেকটাই আমার কাছে অপরিচিত। এর মূল কারণ প্রথমেই বলা বৈরাগ্য নয়, এর মূল কারণ হলো ভিড়।
ভিড় বাদ দিয়ে পুজোর আসল আমেজ কিছুটা পেয়েছিলাম কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালোর শহরে। সালটা 2005। সদ্য ব্যাঙ্গালোরে এসেছি আমার সঙ্গে আরো একজন বাঙালি যিনি কলকাতাবাসী, তাও আবার ম্যাডক্স স্কোয়ারের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে তার বাড়ি। সুতরাং নস্টালজিয়া চরমে, যার কোনটাই আমার বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। মূলত তারই উদ্যোগে খোঁজ পাওয়া গেল কয়েকটি পুজোর যার মধ্যে একটি বাড়ির থেকে হাঁটাপথে।
এই ফাঁকে টুক করে বলে রাখি ব্যাঙ্গালোরে কোনোকালেই ইয়েলো ট্যাক্সি নেই। তারফলে রাস্তায় হাত দেখিয়ে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা অনুপস্থিত। এর বদলে যা আছে তা হল অটো। একে ট্যাক্সির মতই হাত দেখিয়ে দাঁড় করাতে হয়। কিন্তু কোনো অটোওয়ালা ব্যাঙ্গালোরের যেকোন স্থানে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কখনোই যেতে রাজি হয় না। তাই আমরা সাধারণত বাস ব্যবহার করতাম, বাকিটা হেঁটেই পৌঁছে যেতাম। তাই হাঁটাপথে পুজো হচ্ছে জেনে আমরা যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম।
সেই ২০০৫ সালে দাঁড়িয়ে, খবরের কাগজে পড়েছিলাম ব্যাঙ্গালোরে এইরকম ২৫ খানা রেজিস্টার্ড পুজো হয়। বাঙালিরা সে সময় যথেষ্ট পরিমাণে ব্যাঙ্গালোরে উপস্থিত। এদের মধ্যে অনেকেই পুজোর সময় পশ্চিমবাংলায় ফিরে যেতে পারে না। বেশকিছু জন্মগত প্রবাসী বাঙালিও ব্যাঙ্গালোরে বসবাস করেন। তারা ব্যাঙ্গালোরকে নিজের শহর হলেই ভাবেন। তাই পুজোর সময় নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে পুজোগুলি পরিচালনা করেন। এটা যথেষ্ট খাটনির ব্যাপার। চাকরি-বাকরি করার পরে যথেষ্ট সময় পাওয়ার কথা নয়। তার মধ্যেও উৎসাহের অভাব নেই।
অনেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ষাট সত্তরের দশকে ব্যাঙ্গালোরে পাড়ি দিয়েছিলেন তৎকালীন পি এস ইউ অরগানাইজেশন গুলিতে চাকরির জন্য। ব্যাঙ্গালোরে HAL, NAL, BEML, NGEF, DRDO ইত্যাদি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরির সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। এইসবের আকর্ষণে বহু শিক্ষিত বাঙালি তখন কর্নাটকে পাড়ি দিয়েছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। তাদেরই অনেকে শেকড়টা বেশ গভীরে গেঁথে ফেলেছেন।
মূলত এদের উদ্যোগেই পুজোগুলি চালু হয়। ব্যাঙ্গালোরের সবথেকে বড় পুজো সংস্থা হল 'বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন'। শহরটা অনেকটা বড় এবং ছড়ানো। তাই সকলের এক জায়গায় জড়ো হওয়া অনেক সময় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তারফলে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিরা একজোট হয়ে পুজোগুলির আয়োজন শুরু করে। এই করতে করতে বাড়তে থাকে পুজোর সংখ্যা।
প্রথমবার ব্যাঙ্গালোরের পুজোয় গিয়ে আমার যেটা সবথেকে ভালো লেগেছিল তা হল পুজোর দিনগুলিতে খিচুড়ি ভোগ এবং সেই ভোগের ভাগ পুজোয় উপস্থিত সমস্ত দর্শনার্থীদের প্রাপ্য। ঢালাও টেবিল পেতে ভোগের খিচুড়ি সবজি মিষ্টি সহযোগে জমজমাট খাবার-দাবার। বাড়িতে থাকাকালীন বারোয়ারি পুজোগুলিতে এই ধরনের ঢালাও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা দেখিনি। যেহেতু তখন পূজা মণ্ডপগুলোতে তেমন ভিড় হতো না তাই পুজোর উদ্যোক্তারা আপ্যায়ন করতেন সকলকে যাতে আমরা সেই ভোগের খিচুড়ি খাই। আমরাও সানন্দে সেই আপ্যায়ন গ্রহণ করতাম এবং অত্যন্ত আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ বোধ করতাম। এই ধরনের ঘরোয়া পরিবেশ সাধারণত পারিবারিক দুর্গাপুজোগুলোয় দেখা যায়। আমাদের পশ্চিমবাংলার বাণিজ্যিক বারোয়ারি দুর্গাপূজায় যা একেবারেই অনুপস্থিত। উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে কিন্তু দর্শনার্থী জনসাধারণকে আমন্ত্রিত করে খিচুড়ি খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাওয়ার মতন বিরল ঘটনা কল্পনাতীত।
এছাড়াও কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীরা গান গাইতেন। মান্না দে সেই সময়ে ব্যাঙ্গালোরে বসবাস করছেন এবং এই পূজামণ্ডপগুলোতে তাঁর সাথে মাঝে মাঝেই ধাক্কা খাওয়ার মতন পরিস্থিতি তৈরি হত। পশমী নেপালি টুপি পরা মান্না দে কে দেখে আলাদা করে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হত না। তাঁর আশপাশে সবসময় জমে থাকত একটা ভিড়। মান্না দে প্রায় সব পুজোতেই গান গাইতেন। যদিও তাঁর গানের ক্ষমতা সে সময়ে অনেকটাই কমে এসেছে, তবুও ঐরকম এক ব্যক্তিত্বকে চোখের সামনে থেকে দেখার বিরল সৌভাগ্যের অভিপ্রায়ে আমি হাজির হতাম গানের অনুষ্ঠানে। এছাড়াও আসতেন নানা নামি ও অনামি শিল্পীরা। আর থাকতেন স্থানীয় কলাকুশলীরা। সমস্ত সন্ধ্যে জুড়ে একের পর এক এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। আর বিভিন্ন রকম বাঙালি খাবার দাবারের স্টল থাকত। তখন সুইগী, জোমাটো, বাঙালি বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এইসবের এত রমরমা ছিলনা ব্যাঙ্গালোরে। তাই সারা বছর খাস বাঙালি খাবার-দাবার থেকে বঞ্চিত থাকার পর আমরা জমিয়ে প্রায় প্রতিটি পদই পরখ করে দেখতাম। এইসব পুজোমণ্ডপ থেকেই এমন কিছু রেস্টুরেন্টের নাম ও ঠিকানা জেনেছিলাম যাদের সঙ্গে পরিচয় ও যাতায়াত এখনও বজায় আছে।
তাই প্রবাসে পুজো খুব একটা খারাপ কাটত না। অল্পস্বল্প আড্ডা, অনেকটা খাওয়া-দাওয়া, বেশকিছু ঘোরাঘুরি ইত্যাদির পরে মূল যে পাওনাটা হত তা হল বাংলা বইয়ের দোকান। 'বুকসেলার্স এন্ড পাবলিশার্স গিল্ড' থেকে বিভিন্ন প্রকাশনীর বই নিয়ে স্টল বসত মণ্ডপগুলোতে। সময়টা এমন যখন ফ্লিপকার্ট আসেনি, অ্যামাজন নেই, আর ব্যাঙ্গালোরে বাংলা বইয়ের দোকান অস্তিত্বহীন। এইরকম অবস্থায় দাঁড়িয়ে অঢেল বাংলা বইয়ের বিচিত্র সমারোহে নিজে দিশেহারা বোধ করতাম। পকেটে পয়সা নিয়ে পূজো দেখতে যেতাম আর গাদা গাদা বই কিনে বাড়ি ফিরতাম। পুজোর বাজার বলতে যা বোঝায় আমার বোধহয় এটা তাই ছিল। পূজাবার্ষিকী ও নানারকম বাংলা বই সারা বছরের রসদ হয়ে থাকত।
এখন ব্যাঙ্গালোরে পুজোর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কয়েকশো হয়ে গেছে। এরমধ্যে বেশকিছু পুজো হাউসিং কম্প্লেক্সগুলোর মধ্যে অত্যন্ত ঘরোয়াভাবে বসবাসকারী পরিবারদেরদ্বারা পরিচালিত হয় যেখানে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বেশকিছু বাঙালি দুর্গাপুজো কমিটি বাইরের লোকদেরও আমন্ত্রিত করেন তাদের পুজোয় জমায়েত হওয়ার জন্য। এইরকমই প্রায় 100 পুজো এবছর অনুমতি পেয়েছে। গতবছর প্যান্ডেমিকে সংখ্যাটা প্রায় শূন্য ছিল।
এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত কত মানুষের জীবিকা। এটাই বোধহয় পুজোর সবচেয়ে বড় পাওনা। কত ঢাকি সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন পুজোর চারদিন মণ্ডপগুলোতে ঢাক বাজাবেন বলে। পরিবার-পরিজন থেকে দূরে একা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে তাঁরা কি একবারও সন্তানের মুখ মনে করেন না? কিন্তু পেশা এমনই যে সময় থাকতে কাজ না করলে হয়ত আর কাজ পাওয়া যাবে না। আর কাজ না করলে পেট চলবে কেমন করে? চাওয়া পাওয়া নিয়ে আমাদের অবিরত নালিশ এই প্রান্তিক মানুষগুলোর সংগ্রামমুখর জীবনের কাছে কেমন করে জানি নিঃশব্দে হার মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবু পুজো থাকবে, মানুষ আনন্দ করবে এবং তার জন্য মানুষ উপকৃত হবে। এইভাবেই সমস্ত মানবজাতি একত্রে এগিয়ে যাবে উন্নতির দিকে।।
শারদ শুভেচ্ছা, ঋজু ঘোষ, ব্যাঙ্গালোর, ২০২১
Comments
Post a Comment