ব্লকচেইন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি
আজকাল ভারতবর্ষেও ক্রিপ্টোকারেন্সি নামক মুদ্রাব্যবস্থা ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। পশ্চিম দেশে এর বেশ ভাল রকমের প্রচার ও প্রসার রয়েছে। আমরা যদি ট্রাভেলার্স চেক হিসেবে একে ধরি তাহলে বুঝতে সুবিধে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা পুরোটাই ডিজিটাল। এর কোন পেপারওয়ার্ক হয় না। এই পুরো ব্যাপারটা করতে যে টেকনোলজি ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় ব্লকচেইন। ক্রিপ্টোগ্রাফির শর্ত মেনে এই কারেন্সি গোপন ও স্বচ্ছ রাখা হয়।
একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক কিভাবে ব্লকচেইন কাজ করে। তার আগে আমরা অনলাইনে ব্যাংক কেমন করে টাকা পাঠায় সেটা একটু ঝালিয়ে নিই। যদি আপনি কাউকে টাকা পাঠাতে চান তাহলে তার নাম, অ্যাকাউন্ট নাম্বার ইত্যাদি আপনার ব্যাংকে রেজিস্টার করতে হবে। অবশ্যই অনলাইনে । এরপর ব্যাংক সেই তথ্য RBI এর মাধ্যমে ভেরিফাই করবে। এরপর আপনি যখন টাকা পাঠাবেন তখন আপনার একাউন্ট থেকে সেই পরিমান টাকা কেটে নির্দিষ্ট একাউন্টে টাকা জমা পড়বে। এই সমস্ত লেনদেনের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস কাজ করে। যাকে সাধারণত ট্রাস্ট বলা হয়। এখানে আপনি, আপনার ব্যাংক, যাকে পাঠাচ্ছেন তিনি ও তার ব্যাংক --- সকলেই সকলকে চেনেন বা জানেন। দেশের ভেতরে লেনদেন হলে RBI আর বাইরে টাকা পাঠাতে হলে কোন আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী কোম্পানির সাহায্য নিতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ ভাল রকমের প্রসেসিং ফি দিতে হয়।
এই ব্যাপারটি যদি এমন হত যে, কেউ কাউকে চেনে না, ব্যাংক তো দূরের ব্যাপার কেউ তাদের নাম পর্যন্ত জানে না, কিন্তু টাকা-পয়সার লেনদেন হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেআইনি গোপন টাকা-পয়সার এইভাবে লেনদেন হয় যা ধরাও পড়ে। আমরা এখানে সে ধরনের লেনদেনের ব্যাপারে আলোচনা করতে আগ্রহী নই। বরং ধরা যাক আইনত এরকম অচেনা-অজানা দুজন মানুষের মধ্যে টাকা-পয়সার লেনদেন হচ্ছে, যেখানে কেউ একজন সুটকেশ ভর্তি টাকা রেখে যাচ্ছে কোন একটা নির্দিষ্ট স্থানে আর আরেকজন গিয়ে সেই সুটকেস নিয়ে আসছে। অনেকটা পুরনো দিনের হিন্দি সিনেমার মতো। এতে অসুবিধার কিছু নেই কারণ টাকা পয়সা এখানে ফিজিক্যাল, ডিজিটাল নয়।
কিন্তু এই টাকা পয়সাই যদি ডিজিটাল হয় তাহলে ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে যায়। তার কারণ আপনি কপর্দকশূন্য হয়েও কাউকে এক কোটি ডিজিটাল টাকা দিতে পারেন। তার কারণ যেহেতু কেউ আপনাকে চেনে না তাই আপনার কাছে কত টাকা আছে তাও তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং ব্যাপারটি একেবারেই অবাস্তব এবং সম্ভব নয়। তাহলে কোটি কোটি টাকা আমরা একে ওকে তাকে বিলিয়ে বেড়াতে পারব।
এই সমস্যার সমাধান করতে হলে ব্যাংকের মত একটি লেজার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেহেতু লেনদেনকারী পার্টিগুলির মধ্যে কোন যোগাযোগ থাকে না তাই এই লেজার যথাযথ স্বচ্ছ এবং খোলামেলা রাখা হয়। যখন আপনি ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণ করবেন তখন এই মর্মে আপনাকে মুচলেকা দিতে হবে যে আপনার তথ্য ওপেন লেজারে জ্বলজ্বল করবে। অর্থাৎ আমি আপনি সকলেই আপনার কাছে কত টাকা আছে, সেখান থেকে আপনি কত টাকা দিচ্ছেন, ইত্যাদি সমস্ত তথ্য দেখতে পাবো।
ধরা যাক বিটকয়েনে এই রকম একটা ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক। যেখানে তিনজন ট্রানজাকশন করছেন। প্রত্যেকের কাছে 100 টাকা করে আছে। প্রথমজন 10 টাকা দ্বিতীয় জনকে দিলেন। এই 10 টাকা দ্বিতীয় জনকে দিতে গেলে তাকে বাকি সকলের কাছ থেকে অ্যাপ্রুভাল নিতে হবে। অ্যাপ্রুভালের মানে এই যে আপনার কাছে 10 টাকা দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে। এই ধরনের কাজকর্মকে ব্লকচেইন মাইনিং বলে। যেই মুহূর্তে আপনি ট্রানজাকশন করার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন সেই মুহূর্তে বাকিরা মেতে উঠবে আপনার যথেষ্ট পয়সা আছে কিনা সেই তথ্য লেজার থেকে বের করার জন্য। যে সবার আগে বের করে ফেলতে পারবে সেই হবে উইনার। উইনারা এই কাজ করার জন্য সামান্য কমিশন পেয়ে থাকে। নইলে ক আর খ-এর মধ্যে ট্রানজাকশন হচ্ছে এই অবস্থায় গ নির্লিপ্তই থাকবে। যেহেতু মাইনারা কমিশন পায় তাই তারা নিজেদের শক্তিশালী কম্পিউটারগুলো ব্যবহার করে এনক্রিপশন, দেক্রিপশন চালাতে থাকে। যেই মুহূর্তে আপনার অ্যাপ্রুভাল চলে আসবে সেই মুহুর্তে আপনার থেকে 10 টাকা বেরিয়ে আপনার একাউন্টে 90 টাকা পড়ে থাকবে। আর যাকে 10 টাকা পাঠালেন তার অ্যাকাউন্টে মোট 110 টাকা দেখাবে।
এই লেজারকে ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার বলে। তার কারণ এই লেজারটির একটি করে কপি প্রত্যেকের কাছে থাকে। যেই মুহুর্তে ট্রানজেকশন শুরু হচ্ছে সেই মুহূর্তে লেজার আপডেট হয়ে যায়। প্রত্যেকে তাদের নিজেদের কপিগুলিকেও আপডেট করে ফেলে। এই লেজারে মডিফিকেশন হয়না। অর্থাৎ কাটাকুটির কোন গল্প নেই। যা হবে তা যোগ করা হবে। মনে করুন একটি বাজারের লিস্ট যেখানে এক কেজি আলু কিনতে বলা আছে তার বদলে যদি আপনাকে দু কেজি আলু কিনতে হয় তাহলে আরও ১ কেজি আলু সেখানে যোগ করা হবে। কাটাকুটি করা চলবে না।
যেহেতু এই লেজারটি ট্যাম্পার প্রুফ তাই সকলেই একে চোখ বন্ধ করে ভরসা করে। আর এর জন্য জটিলতম ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করা হয়। কখনো Asymmetric Encryption যা পাবলিক key, প্রাইভেট key দ্বারা পরিচালিত, ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ আপনি চাইলেও একে বদলাতে পারবেন না। যেই মুহূর্তে একে বদলানোর চেষ্টা করবেন সেই মুহুর্তে আপনার ledger কপিটি ইনভ্যালিড হয়ে যাবে আর তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
একটি ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে কোন সেন্ট্রাল সিস্টেম বা ডাটাবেস থাকে না। ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার যা প্রত্যেক ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণকারী সকলের কাছেই থাকে সেটাই একমাত্র ও চরম সত্য।
আরো একটি বিষয় লক্ষ করার মতন এখানে যে RBI, ভিসা এই জাতীয় কোন মধ্যস্থানীয় সংস্থা এই লেনদেন প্রথায় কাজ করে না। এরফলে ট্রানস্যাকশন ফি অত্যন্ত নগণ্য যা সাধারণত ব্লকচেইন মাইনারদের কমিশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু কোন কেন্দ্রীয় মধ্যস্থতা নেই তাই এই লেজারগুলি সকলের কাছেই সহজলভ্য থাকে। যেই মুহুর্তে কেউ তার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে টাকা কাউকে দেওয়ার চেষ্টা করবে সেই মুহূর্তে কোন অ্যাপ্রুভাল না আসায় তা লেজারে এন্ট্রি হবে না অর্থাৎ ট্রানজাকশন ঘটবে না।
শেষ ট্রানজাকশনের আগের ট্রানজাকশন ধরতে গেলে ধীরে ধীরে একটি শেকলের মত ট্রানজাকশন এর লিস্ট তৈরি হবে। এই চেইন অফ ব্লক থেকেই ব্লকচেইন কথাটি এসেছে।
বিটকয়েন জাতীয় ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।।
--
ঋজু ঘোষ, ২৫শে অক্টোবর ২০২১
Comments
Post a Comment