৫ টাকায় বই ও প্রিন্ট অন ডিমান্ড

 শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই হচ্ছে। বাংলার এক প্রথম সারির প্রকাশক বেশ কিছু বই মাত্র ৫ টাকায় ছেড়ে দিচ্ছেন। হতেই পারে সেগুলি হয়ত বিক্রি হচ্ছিল না, আমার তাতে কী? কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন এই বই বিক্রির টাকা লেখকরা পাবেন তো? মানে পেলেও ঠিক কতটা পাবেন? শতকরা ১০% হারে রয়্যালটি পেলে বই পিছু ৫০ পয়সা করে পাবেন। প্রকাশক কি বলবেন, 'বই ছাপানোর পয়সাই ওঠেনি তার আবার রয়্যালটি কোথা থেকে আসবে?' একজন বই ক্রেতা হিসাবে আমার এইসব ভাববার কথা না। বরং খুশি মনে বেশ কিছু বই ৫ টাকায় কিনে আলমারি ভরিয়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগছে। 


দেশ পত্রিকাও একসময় ৫ টাকায় নেমে এসেছিল। তবে দেশ চলে মূলত বিজ্ঞাপনের টাকায়। সেখানে লাভ থাকেই। তাই কম দামে ছাড়লেও দেশ তার লেখকদের পয়সা নিয়ে কোন সমঝোতা করেনি। তাই এর সাথে তুলনা করলে চলবে না। কোন বই চলবে কোন বই চলবে না বলা মুশকিল। এমন সব বই বেস্ট সেলার হয়ে যায় যেগুলি কোন প্রকাশক কল্পনাই করতে পারে না। ফরাসী লেখক মারসেল প্রুস্তের "অতীতের স্মৃতিরোমন্থন" নামে একটি বই স্বয়ং আন্দ্রে জিদ এক প্রকাশকের হয়ে নাকচ করে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য জিদ নিজের ভুল স্বীকার করে নেন ও প্রুস্তকে চিঠিও লেখেন। সমারসেট মম বলেছেন, প্রুস্তের এই সুবিশাল উপন্যাস সকলের অবশ্য পাঠ্য। বাংলায়ও এইরকম উদাহরণ আছে, "রামকৃষ্ণ কথামৃত"। লেখক নাকি একসময় প্রকাশকই পাচ্ছিলেন না। তাই নিজের পয়সায় তা বের করেন। সাম্প্রতিক ইরোটিক সাহিত্যের ১০ লক্ষ কপি বিক্রী হওয়া উপন্যাস "ফিফটি শেডস অফ গ্রে" কিন্তু প্রথমে লেখিকাদ্বারা প্রিন্ট অন ডিমান্ডে প্রকাশিত। কিছু কপি বিক্রি হবার পরে এক প্রকাশকের নজরে আসে ও তারা এগিয়ে এসে ছাপেন। এরপর বাকীটা ইতিহাস। আমার ধারনা এই একটি বই লিখে লেখিকা সুনীলের মত একটি পাহাড় কিনে ফেলেছেন। যা বাংলায় লিখে অর্জন করা মুস্কিল। উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে, ধরা যাক লেখিকা ১ ডলার করে একটি বই বিক্রির জন্যে পাচ্ছেন, তাহলে ১০ লক্ষ কপি বিক্রী হলে পাবেন, ১০ লক্ষ ডলার। আমি কম করেই হিসাব করলাম, বইয়ের রয়্যালটি বেশিই হবে আর বিক্রিও বহুগুণ। ১০ লক্ষ ডলার মানে ভারতীয় মুদ্রায়  ৭ কোটি ৫ লক্ষ টাকা? কী কেমন? 


বই লিখেও প্রচুর বড়লোক হওয়া যায় যদি তার বিক্রি থাকে। বিক্রি না হলে লেখক ও প্রকাশক দুইয়েরই ক্ষতি। এখন টেকনিক্যাল সব বই প্রিন্ট অন ডিমান্ডে বের হয়। এতে সুবিধে অসুবিধে দুইই আছে। অসুবিধে হল, যেহেতু বই একসাথে অনেকগুলি ছাপা হচ্ছে না তাই এক একটি কপির ছাপার খরচ বেড়ে যায়, ফলে একটি বইয়ের দামে তুলনায় বেশি হয়। সুবিধে, এতে প্রকাশকের ক্ষতি কম কারন পাঠক হয়ত ১০০ টাকা বেশি দিচ্ছেন। কিন্ত ছাপার পরে বিক্রী না হলে প্রকাশকের লক্ষ লক্ষ টাকা জলে যাওয়া খুব একটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। মনে রাখতে হবে, একজন প্রকাশক কেবলমাত্র একটি মানুষ নন এরসাথে জড়িয়ে থাকে অসংখ্য পরিবার যাদের সংসার বই বিক্রীর লাভেই চলে। প্রকাশক যদি বই নাই ছাপেন তবে আমি আপনি বই কিনব কীভাবে? আর তা সাজিয়ে ছবি তুলে দেখাবই বা কেমন করে? তাই এই ইন্ডাস্ট্রী বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। না বিক্রী হওয়া বই গোডাউনে জমে থাকা কোন কাজের কথা নয়। একে তাড়াতাড়ি ক্লিয়ার করাই শ্রেয়। 


তবে এটা করতে গিয়ে ৯৫% হারে ছাড় দেওয়া মানে নিজের পায়ে নিজেই কোপমারা। এরপর ক্রেতা ছাড় ছাড়া বই কিনবেই না। ছাড় মানে ১০-২০ % না এক চেয়ে অনেক বেশি ছাড় প্রত্যাশা করবে। বসে থাকবে তীর্থের কাকের মত কখন আবার ছাড় আসবে। এই ট্রেণ্ড এখন অনলাইন জামাকাপড়ের ব্যাবসায় চলছে। মানুষ দোকানে গিয়ে ছাড়হীন জামাকাপড় কেনেই না। নিউ আরাইভ্যাল অচ্ছুত অবস্থায় পড়ে থেকে থেকে পুরানো হয়। পরে তা ছাড়ের আওতায় পড়বে আর মানুষ তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে এগুলিই কিনবে। 


ইংরাজি ভাষার অনেক বইই কিন্তু প্রিণ্ট অন ডিমান্ডে হৈ হৈ করে বিক্রি হয়। বাংলায় কেন হবে না? নাকি আমরা ভয় পাচ্ছি মানুষ বেশি পয়সা দিয়ে কিনবে তো?  সমরেশ বসু রচনাবলীর কিছু খণ্ড ১০০০ টাকা দাম, দেখি নাই ফিরে ২০০০ টাকা, সত্যবতী ট্রিলজি ১১০০ টাকা। বিক্রী কি হচ্ছে না? যারা কেনার তারা কিনছেই। মানুষ গড়ে ১০০০০ টাকার বেশি মোবাইল পকেটে নিয়ে ঘোরে। আমরা ছাত্র অবস্থায় ঘড়িপরা কাউকে দেখলেই বড়লোক ভাবতাম। এখন শুনলে অবাক লাগবে। ১৫ বছর আগেও বাসে মোবাইয়ের রিংটোন শোনা গেলে সারা বাসের সবাই একবার তাকাতই। কে মোবাইল নিয়ে উঠেছে? নিশ্চই অনেক পয়সা। এখন কেউ তাকায়? বরং কানের সামনে আওয়াজ হলে বিরক্ত হয়। তাই ভাববার সময় এসেছে। 

"প্রিণ্ট অন ডিমান্ড" নিয়ে ভাবুন ভবিষ্যতের স্বার্থে। 


ঋজু, ৮ মার্চ ২০২১, ব্যাঙ্গালোর 

Comments

Popular posts from this blog

ভিনসেন্ট ভ্যানগখ এর সাথে

Cooch Behar a Pop History (ইতিকথায় কোচবিহার)

Durga Puja 2013 in Bangalore